…সেই দুপুরেই অঘটন ঘটে গেল। সকলে তখন ঘুমে। বাড়ির একটা ঝিয়ের হঠাৎ চোখ গেল পুকুরের ওপারে ঝোঁপের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে বড় কর্তার মেয়ে হাসিরানী। বাড়ি কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল ঝিটা। তারপর পড়ি-মরি করে ছুটল তাকে ধরে আনতে। এত থেকে চিৎকার চেঁচামিচি শুনতে পাওয়ার কথা নয়, শোনা গেলও না। হাসিরানী তখন আপনমনে ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে অনেকটা। চলে গেছে, আর তাকেও দেখা যাচ্ছে না। ঝিটা একাই তারস্বরে চিৎকার করতে করতে পুকুরের ধার ধরে ছুটল। আর কেউ এগোতে সাহস করছে না–হাসিরানীর কাকীমারা দোতলায় দাঁড়িয়েই কাঁপছেন ঠকঠক করে।
ঝিটা চিৎকার করতে করতে সবে পুকুরের ওপারে পৌঁছেছে-হঠাৎ একেবারে কাছেই বাঘের প্রলয়ংকর গর্জন–চতুর্দিক কাঁপিয়ে দিয়ে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে-রকম গর্জন করে ওঠে তেমনি। গর্জন আর থামে না। ঝোঁপঝাড়ের ওধারেই ওটা যেন লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করছে একটা। ঝি-টা আবার আর্তনাদ করতে করতে তীরের মতো এপারে ছুটে এসে মাটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কর্তাদের বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। লোকনাথ আর মন্মথও ছিল।
খানিক বাদে বাঘের গর্জন থেমেছে।
সকলে যা বোঝবার বুঝে নিয়েছে। বড়কর্তার রূপসী বোবা মেয়েটাকে বাঘে টেনে নিয়ে গেল। সকলেই বলাবলি করল, মেয়েটা যেন আত্মঘাতিনী হল। ইচ্ছে কবেই বাঘের মুখে গিয়ে পড়ল।
লোকনাথেরও সেটাই স্থিরবিশ্বাস। আত্মাহুতি দিয়ে সে তাকে এবং অন্য সকলকে অব্যাহতি দিয়ে গেল। তারপর আর কোনদিন বাঘের ডাক শোনা যায় নি। দুদিন বাদে জঙ্গল তল্লাস করা হয়েছিল অনেক লোকজন নিয়ে, কিন্তু মূষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে এর মধ্যে বাঘের বা রক্তের কোনো চিহ্নও মেলেনি।
.
সমস্ত মুখ দিয়ে হাসি চুয়ে চুয়ে পড়ছে হাসিরানীর। পাশ থেকে বড় ছেলের সহাস্য উক্তি, কাকা, আমরাও বাবা আর দাদুর মতো ভয়ংকর বাঘের ডাক ডাকতে পারি–আপনাকে শোনাতে বলছেন!
লোকনাথবাবু হাসিরানীর দিকেই চেয়ে আছেন আর হাসছেনও। চা-জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে–অন্য ছেলেরা আর বউরাও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।
লোকনাথবাবু বড় ছেলেকে বললেন, তার থেকে তোমার বাবার একখানা ফটো থাকে তো আমার বড় দেখার ইচ্ছে।
মায়ের ইশারায় বড় ছেলে তাকে নিয়ে সামনের ঘরে ঢুকল। সামনের টেবিলেই টাটকা মালা পরানো মস্ত একখানা ফটো। ফটোর মধ্যে দাঁড়িয়ে মগন যেন হাসছে তার দিকে চেয়ে। হাঁটুর ওপর কাপড় তোলা। পাথরে খোদাই করা দেহ।
ফিরে এসে লোকনাথবাবু বসলেন আবার। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। কিন্তু লোকনাথবাবুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের ঠোঁট-নাড়ার দিকে খানিক মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থেকে বড় ছেলে তার দিকে ফিরল।-মা আপনাকে যে জন্য ডেকে এনেছেন, এতক্ষণ সেটাই আপনাকে বলা হয়নি। শুনে আপনিও মতামত দেবেন।
এবারে যে কথাগুলো বলে গেল সে, শুনে লোকনাথবাবু স্তব্ধ খানিকক্ষণ।
–চার ছেলেকে মা তার মনের মতো করে মানুষ করেছে, মায়ের হুকুমে তাদের লাঠি চালানো, ছোরা খেলা আর বন্দুক ছোঁড়া শিখতে হয়েছে। শিকারে পটু হতে হয়েছে। মা সর্বদাই বলতেন তার একটা কাজ ছেলেদের করে দিতে হবে–আর সেই কাজের জন্য বড় হয়ে তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রস্তুত হবার ব্যাপারে বাবাই ওদের সাহায্য করেছেন। মারা যাবার আগেও তিনি বলে গেছেন, মা যা বলে তাই করবি, তাতে জান যায় যাক!
সেই কাজের সময় এসেছিল ছ বছর আগে। মায়ের হুকুমে আচমকা ঘেঁকে। ধরে ঠিক ডাকাতের মতোই মায়ের বাপের বাড়ির কর্তাদের দু ভাইকে আর তাদের চার ছেলেকে আটক করে আনা হয়েছিল। তাদের গায়ে কেউ হাত তোলেনি, কিন্তু ভয়ে তারা তখন আধমরা। তার তিন ভাই বন্দুক হাতে ওই চার ছেলেকে পাহারা। দিয়েছে–আর বড় ভাই আলাদা ঘরে মায়ের দুই কাকাকে। মা শুধু তার কাকাদের ঘরে এসেছেন, প্রণাম করেছেন, তারপর তার মারফৎ কাকাদের জানিয়েছেন-পৈতৃক সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ মায়ের পাওনা–তার বিনিময়ে নগদ মূল্য না পেলে ছেলেদের হাত থেকে ওঁদের ছেলেদের রক্ষা করা যাবে না। মায়ের কাকারা অনেক মিনতি করেছেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য, ছেড়ে দিলে যথাসাধ্য ব্যবস্থা করবেন।
মা অবিচল কঠিন। তার হুকুম, কাকার ছেলেরা তার জিম্মায় থাকবে, কাকারা টাকা আনার জন্য যেতে পারেন–পাঁচ দিন সময়, তার মধ্যে তাদের ছেলেদের কেউ কেশ স্পর্শ করবে না–কিন্তু পাঁচদিনের মধ্যে টাকা না নিয়ে এলে আর তাদের রক্ষা করার কোনো দায়িত্ব তার থাকবে না।
…কাকারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। মাকে, মা রাজি হননি। শেষে সত্তর হাজার টাকায় রফা হয়েছে।
পাঁচদিনের মধ্যে সেই টাকা তারা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে ছেলেদের মুক্ত করে নিয়ে গেছেন।
হাসিরানী চেয়ে আছে লোকনাথবাবুর দিকে। একাগ্রভাবে যেন সে জানতে চায় কিছু। লালচে মুখ গম্ভীর এখন।
বড় ছেলে বলল, এখন মায়ের জিজ্ঞাস্য, এ-ভাবে দাবি আদায় করে মা পাপ করেছেন কিনা, অন্যায় করেছেন কিনা।
লোকনাথবাবু মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে ছিলেন তার দিকে। এরকম রমণী তিনি এ জীবনে আর দেখেন নি। বললেন, কোনো পাপ করোনি, কোনো অন্যায় করোনি তুমি যা করেছ তোমার ছেলেরা তা সোনার অক্ষরে লিখে রাখে যেন, বংশ বংশ ধরে সকলে যেন জানতে পারে।