মন্মথর সঙ্গে লোকনাথের সেদিন দস্তুরমতো রাগারাগিই হয়ে গেছল।
পরের বছর। হাসিরানীর আঠেরো আর ওদের কুড়ি।
মন্মথ ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে না পেরে এখানেই থাকে, তার বাপের সঙ্গে বাবুদের কাজকর্ম দেখে। কিন্তু আসলে কিছুই করে না। লোকনাথ ততদিনে খুব ভালোভাবে আই-এ পাস করে সেবারে বি-এ পরীক্ষা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে কমাসের জন্য ঘরে ফিরেছে।
বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কাকা-কাকীমার খুব হাসিমুখ দেখল। এতটা সচরাচর দেখে না।
মন্মথ ফাঁক পেয়েই তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর তাজ্জব কথা শোনালো। তিন মাস আগে হাসিরানীর কাকারা এক বউ-মরা আধবয়সী লোকের সঙ্গে হাসিরানীর বিয়ের ঠিক করেছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল সেই লোকটার মাথা কে দুর্ফাক করে দিয়েছে-প্রাণে বেঁচে সে আর বিয়ের নামও করছে না।
হাসিরানীর কাকারা তখন মন্মথর বাবাকে ধরেছে। লোকনাথের সঙ্গে হাসিরানীর বিয়ে দিতে হবে। তার জন্যে কাকারা অনেক টাকাও খরচ করবেন। ওর বাবা নাকি তাতে রাজি হয়েছেন। লোকনাথ এসেছে, এবারই বিয়েটা হয়ে যাবে।
লোকনাথের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার তখন ভবিষ্যৎ-চিন্তা অন্যরকম। কমপিটিটিভ পরীক্ষা দেবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তার মধ্যে কিনা বিয়ে! আর যত রূপসীই হোক, একটা বোবা মেয়েকে বিয়ে করবে ও! কক্ষনো না, কক্ষনো না।
এরপর কাকা-কাকীমা ওঁকে খবরটা জানালেন। লোকনাথ মাকে বলল, সে এখন বিয়ে করবে না।
কাকা ততোধিক গম্ভীর। ধমকে বললেন, এটা ফাজলামোর ব্যাপার নয়, কর্তারা নিজের মুখে এ প্রস্তাব দিয়েছেন তার ভাগ্য ভালো। তাদের কথা দেওয়া হয়ে গেছে, এর আর নড়চড় হবে না।
লোকনাথ ঠিক করে ফেলল, বিয়ের আগেই সে পালাবে। জীবনে সে আর এ-মুখো হবে না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট হল তার। রূপ যেন ফেটে পড়ছে। ওর সঙ্গে দেখা হতেই ফিক করে হাসল, গালে টোল পড়ল সেই হাসি সমস্ত মুখে ছড়ালো। চটপট সরে পড়ল সে।
লোকনাথ বুঝল মেয়েটাও শুনেছে সব। দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু বিয়ে সে এখানে করতে পারবে না– পালাবেই।
পরদিন দুপুরে মেঘলা দিন দেখে পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছিল লোকনাথ। জঙ্গলের পরিবেশ তার ভালো লাগে।
হঠাৎ বিষম চমকে উঠল। সামনে হাসিরানী। ওকে দেখে সেও ভয়ানক চমকে উঠেছে। ঘাটের থেকে বেশি দূরে নয় অবশ্য জায়গাটা। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করল, হাসিরানী, তুমি এখানে একলা কি করছ?
হাসিরানীর মুখে লালের ছোপ লাগল। কিন্তু মুখ শুকনো। লোকনাথ ভাবল, পাছে। বাড়িতে বলে দেয়, সেই ভয়।
লোকনাথ বলল, আমি কাউকে কিছু বলব না। শোনো..বাড়ির সব কি কাণ্ড করতে যাচ্ছে শুনেছ?
হাসিরানী মাথা নাড়ল– শুনেছে।
–ইয়ে…তুমি কি বলো?
মুখের দিকে সোজা তাকালো। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি। বিপরীত মাথা নেড়ে আপত্তি জানালো কিছু।
–বিয়ে করতে চাও না?
আবার মাথা নাড়ল– চায় না।
–আমি কি করব? আপত্তি করব?
মাথা নেড়ে সায় দিল।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল লোকনাথের। বলল, আমি ভাবছি এখান থেকে পালিয়ে যাব!
এবারে একগাল হেসেই সায় দিল। অর্থাৎ সেই ভালো।
লোকনাথ চলে এলো। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে অবাকই লাগছে তার। শেষে। ভাবল, বিয়ে কাকে বলে ও বোধহয় তাই-ই জানে না।
এমন দিনে সমস্ত এলাকায় যেন হঠাৎ নাড়াচাড়া পড়ে গেল একটা। ভয়ে সক্কলের মুখ শুকালো। পশ্চিমের জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যায় বাঘের ডাক শোনা গেল। দূরে অবশ্য, কিন্তু বাঘের কাছে কত আর দূরে? বারোশিঙা হরিণেরও বিদঘুঁটে ডাক শোনা যেতে লাগল! বাঘের পদার্পণ ঘটলে তারা অমনি ডেকে নিজেরা হুঁশিয়ার হয়, আর অন্য জীব-জন্তুকেও হুশিয়ার করে।
পর পর দু-তিন দিন দূরে দূরে বাঘের ডাক শোনা যেতে লাগল। তার পরের দিন দিনের বেলায়ও শোনা গেল। কর্তাদের বন্দুক আছে দুদুটো। কিন্তু সে বন্দুক হাতে নেবার মতো আর মানুষ নেই। পাহারাদার আছে একটা। তার কাঁধে একটা বন্দুক উঠল। কিন্তু ভয়ে তারও মুখ আমসি। কর্তারা শহরে খবর পাঠালেন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো সাড়া আসছে না।
…দূরে পশ্চিমের জঙ্গলে আগে বাঘের উপদ্রব খুবই ছিল। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে সে ভয় নির্মূল হয়ে গেছে। কত বাঘ যে মারা পড়েছে ঠিক নেই। অন্য কোনো জঙ্গল থেকে ছিটকে-ছটকে এসে গেছে একটা। অত দূর থেকেও এমন গুরুগম্ভীর ডাক শোনা যায় যখন, বড় বাঘ সন্দেহ নেই। যতো দূরেই হোক, বাবুঘাটের ত্রিসীমানায় লোক মাড়ায় না। ঝোঁপঝাড় গাছপালার পরেই তো ঘন জঙ্গল শুরু। বড়-জোর এক-দেড় মাইল। ঘাটের দিকের কর্তাদের বাড়ির জানলা-দরজা পর্যন্ত অষ্টপ্রহর বন্ধ। ত্রাসে দিশেহারা সকলেই। লাঠিসোটা টিন কানেস্তারা নিয়ে লোকজন সন্ধ্যার পর থেকে সমস্ত রাত কর্তাদের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
সেদিন সকালের দিকেই বাড়ির সকলের রক্ত জল। পুকুরের ওপারে ঝোঁপ-ঝাড়ের কাছাকাছি বাঘের গরগর গলার শব্দ পাওয়া গেছে–আর দিনমানেই বারো-শিঙারা ডাকাডাকি ছোটাছুটি করেছে। লোকনাথরাও কর্তাদের বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে পুকুরের ওপারের দিকে চেয়ে ছিল– আবার দরকারমতো ছোটার জন্যও প্রস্তুত ছিল সকলে।
কিন্তু বাঘের আওয়াজ আর শোনা গেল না। কেউ কেউ মন্তব্য করল, বাঘ ওদিকের ধারেকাছেই খেয়েদেয়ে ঘুম লাগিয়েছে।