হাসিনীর বয়স তখন পাঁচ, লোকনাথ আর মন্মথের সাত, আর ওই মগনের চৌদ্দ। লোকনাথ বা মন্মথ মগনকে তেমন পছন্দ করত না, কুচকুচে কালো ছোঁড়াটা হাড়পাজী–আর গায়ে জোরও তেমনই, যখন-তখন ধরে রামঝকানি-টাকানি দিত। মেয়েটাকেও এক-একসময় দু হাতে একেবারে মাথার উপর তুলে ফেলত। কিন্তু হাসিরানী একটুও ভয় পেত না, নীরব হাসিতে ওর সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ হয়ে যেত।
পাঁচ বছরে হাসিরানীর বাবা মারা গেছলেন, সাত বছর না হতে তার মা-ও চোখ বুজলেন। স্বামী অঘটনে মারা যাবার পর থেকেই মহিলা জীবন্থত হয়ে ছিলেন। সকলেই বলাবলি করতে লাগল মেয়েটা অভাগা, বিশেষ করে হাসিরানীর কাকা কাকীমারা, আর লোকনাথের কাকীমাও।
মগনের তখন ওকে আগলাবার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। সে-ই যেন গার্জেন ওর। কর্তাবাবুদের চোখের আড়ালে মেয়েটার ওপর মগন দস্তুরমতো হম্বিতম্বি করত, একটু-আধটু শাসনও করত। কিন্তু লোকনাথ বা মন্মথ এমন কি হাসিরানীর খুড়তুতো ভাইরাও ওর সঙ্গে লাগতে এলে মগন মারমুখী একেবারে। সে-বেলায় কারোও ক্ষমা নেই।
বুড়োকর্তা সময়ে চোখ বুজলেন। হাসিরানীর বয়স তখন নয়। মগনের আঠেরো। পেল্লায় জোয়ান হয়ে উঠেছে। পাথুরে কালো গায়ের রং-এ যেন জেল্লা ছোটে। ওই ফুটফুটে মেয়েটার হাত ধরে পুকুরের পশ্চিম দিকের ঝোঁপঝাড় বনে-জঙ্গলে যখন ঘুরে বেড়াতো–তখন অদ্ভুত দেখতে লাগত। তপ্তকাঞ্চন আর নিকষ কালোর দুই সচল মূর্তি। পশ্চিমের ওই জঙ্গলই বড় জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। মেয়েটাকে ওদিকে নিয়ে যেত বলে গিন্নিদের কাছে বকাঝকা খেত মগন। কিন্তু ও তাদের কথা কানেই তুলত না। ফলে তারাও মগনের ওপর ক্রুদ্ধ। হাড়
এই সময়ে মগনের চাকরিটা গেল। বাবুদের চোখ দিয়ে দেখতে গেলে অপরাধ গুরুতরই বটে। প্রথম অপরাধ, নিষেধ সত্ত্বেও, পুকুরের পশ্চিম দিকে নিয়ে গেছে। মেয়েটাকে। তার সঙ্গে মেজকর্তার এক ছেলেও ছিল। কি কারণে রেগে গিয়ে মগন হাসিরানীর এত জোরে হাতটা ধরেছে যে বোবা মেয়েটা বীভৎস আর্তনাদ করে উঠেছে একটা। গালে রক্তের চাপ ধরে গেছে। মেজকর্তার ছেলে কি বলে উঠতে তার গালেও একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।
গিন্নিরা কর্তাদের কাছে নালিশ করেছেন। মেয়েটার গালের দাগ দেখিয়েছেন। ছেলের গায়ে হাত তোলার কথাও বলেছেন শুনে মেজকর্তা পায়ের চটি খুলে মগনকে বেশ করে প্রহার করে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন। এ-বাড়ীর ত্রিসীমানায় আর তাকে দেখা গেলে গায়ের ছাল থাকবে না, তাও বলে দিয়েছেন।
মগনের চাকরি যেতে সকলেই খুশি, এমন কি লোকনাথও কেবল ওই মেয়েটা ছাড়া। মগন ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
মগনকে কিন্তু প্রায়ই পশ্চিমের পুকুরঘাটের জঙ্গলের দিকে ঘুরঘুর করতে দেখা যেত। বিশেষ করে দুপুরে, কর্তারা যখন বাড়ি থাকেন না– আর গিন্নিরা যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন। হাসিরানীকে চুপি চুপি ওর কাছে যেতে দেখা গেছে। আবার অন্য ভাইদের নালিশের ফলে ধরাও পড়ত হাসিরানী। রেগে গিয়ে কাকীমারা তখন ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতেন। মেয়েটা কিন্তু কাদত না বড়-একটা।
মেয়েটা অপয়া, মেয়েটা বোবা। কাকীমাদের অত্যাচার বাড়তেই থাকল ওর ওপর। আর মেয়েটাও একগুঁয়ে তেমনি। মারুক ধরুক, জঙ্গলের দিকে যাবেই–ফাঁক পেলে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবেই। কাকীরা ছেড়ে কাকারাও কতদিন মারধর করেছেন ঠিক নেই।
হাসিরানীর চোখে জল গড়ায়, কিন্তু গলা দিয়ে কান্নার শব্দ বেরোয় না। কিন্তু এই মেয়ের হাসি যেন এক অদ্ভুত জিনিস। হাসিটা যেন ছোঁয়াচে রোগের মত ওর। কারণে-অকারণে হাসতে হাসতে রক্তবর্ণ হয়ে যায় একেবারে। তখনো গলা দিয়ে শব্দ বার করে না বিশেষ। হাসলে গালে টোল খায় আর হাসিটা যেন তার মধ্যেও লুটোপুটি খায়।
ওকে হাসাতে বড় ভাল লাগত লোকনাথের। একটু চেষ্টা করলেই হাসাতে পারত। ও মেয়ে সর্বদাই যেন হাসার জন্য তৈরি হয়ে আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে যখন, তখনো মনে হয় হাসি-হাসি মুখ।
চৌদ্দ ছেড়ে পনেরয় পা দিয়ে এই মেয়েই বাড়ির অশান্তির কারণ হয়ে উঠল। এত রূপ সচরাচর চোখে পড়ে না। তেমনি স্বাস্থ্য। কিন্তু বুদ্ধি যেন হয়ইনি। এখনো সেই হাসি মুখে লেগে আছে–আর পশ্চিমের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আছে। কাকীমাদের। চোখের বিষ ও এখন। এখনো গুম-গুম কিল বসিয়ে দেন তারা, চুলের ঝুঁটি ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন। বাড়ির আঙিনার বাইরে সেদিন ওকে মগনের সঙ্গে ঠোঁট নাড়তে দেখে আর হাসতে দেখে তো কাকীমারা রেগে এমন আগুন যে, কাকারা পর্যন্ত সেই নালিশ শুনে রীতিমতো মেরেছেন ওকে। আর দুদিন দরজায় শিকল তুলে দিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছিলেন।
সেই সময় মন্মথ প্রায়ই বলত, হাসিরানীকে দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন করে। লোকনাথ ঠিক বুঝতে পারেননি তখনো, কেমন করে ওর বুকের ভেতরটা। মেয়েটাকে দেখলে লোকনাথের আগের থেকে ঢের বেশি ভালো লাগে এই পর্যন্ত কিন্তু বুকের ভিতর কেমন করে-টরে না।
বছর দুই বাদে বুঝতে পারল, মন্মথর বুকের ভিতরটা কেমন করে। হাসিরানীর তখন সতের, ওদের উনিশ। নীল ডুরে শাড়ি পরে যখন ঘুরে বেড়ায়, চোখ ফেরানো যায় না। মন্মথ ততদিনে আরো সেয়ানা হয়েছে। একদিন চুপি চুপি বলল, হাসিকে দেখলাম পশ্চিমের ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রায়ই যায় ওদিকে, মেয়েটা তো কথা বলতে পারে না–একদিন ধরব চেপেচুপে!