বক্তব্য বুঝে নিয়ে ছেলে লোকনাথবাবুকে বলল, মা বলছেন– আপনাকে হঠাৎ এভাবে ধরে নিয়ে খুব কষ্ট দেওয়া হল!
লোকনাথবাবু সম্বিত ফিরে পেলেন যেন এতক্ষণে। বললেন, না, কষ্ট কিছু না। তোমার মা-কে আজ তেত্রিশ বছর বাদে দেখলাম… কোনদিন দেখব ভাবিনি, তাই অবাক হয়েছি।
ছেলে হাসিমুখে বলল, আপনি তো আসতেই চাননি, ভাবলেন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছেন! মায়ের দিকে চোখ পড়তেই সে আবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না মা, সত্যিই একটুও খারাপ ব্যবহার করিনি–তুমি জিজ্ঞাসা করে দেখো না
সমর্থনের আশাতেই যেন হাসিরানী লোকনাথবাবুর দিকে তাকালো। অদ্ভুত লাগছে। লোকনাথবাবুর। এখনো যেন সবকিছু বাস্তব ভাবতে পারছেন না তিনি। হাসিরানীর বয়েস বড়জোর বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকনাথবাবু জানেন, হাসিরানীর বয়েস এখন একান্ন–ঠিক দু বছরের ছোট তার থেকে।
বললেন, না, ওরা খারাপ ব্যবহার করেনি, তোমাকে দেখব কল্পনা করিনি তো, তাই আসতে ইতস্তত করছিলাম।
হাসিরানীর মুখে আবার সেই হাসি। ছেলের দিকে ফিরে একবার ঠোঁট নাড়লেন শুধু। সে তক্ষুনি উঠে লোকনাথবাবুর পায়ে হাত রেখে প্রণাম করল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিন ছেলেও।
হাসিরানী তাদের দিকে চেয়ে আবার ঠোঁট নাড়তে পরের ছেলে জানান দিল, মা বলছেন আমরা মায়ের এই চার ছেলে।
লোকনাথবাবু বলে উঠলেন, বেঁচে থাকো বাবারা, সুখে থাকো।
হাসিরানী বরাবরই রূপসী, কিন্তু এই হাসিমুখ অদ্ভুত কমনীয় দেখালো। আবার তার ইশারা পেয়ে বড় ছেলে হাঁক দিল, আর বউরা সব কোথায়, এদিকে এসো, মা ডাকছেন–
ইত্যবসরে যে বউটি সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেও প্রণাম সেরে উঠল। সেই বোধহয় বড় বউ। সুশ্রী। আরো তিনটি সুশ্রী বউ ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রণাম করল।
বড় ছেলে হাসছে। মা বলছেন, এই তার চার বউ।
আশ্চর্য, মায়ের ঠোঁট নড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে তার কথা এমন পরিষ্কার বুঝে নেয় কি করে লোকনাথবাবু ভেবে পেলেন না। হাসিমুখে হাসিরানী আদুরের বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটোকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটে এলো। বড় ছেলে বলল, প্রণাম করো, দাদু
লোকনাথবাব তাদের ধরে ফেললেন।
বড় ছেলে বলল, এই মায়ের দুই নাতি-নাতনী–এটি আমার ছেলে, এটি ভাইয়ের মেয়ে
সুন্দর ঝলমলে সংসার। কি মনে হতে লোকনাথবাবু হাসিরানীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কেউ নেই?
ফর্সা মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগল। ম্লান স্নিগ্ধ দুটো চোখ তার মুখের ওপর স্থির হল একটু। তারপর সামান্য মাথা নাড়ল– নেই।
বড় ছেলে বলল, দশ বছর আগে বাবা ব্ল্যাক ফিভারে মারা গেছেন।…এদিকটায় তখন ওই রোগ খুব হত। তারপর হেসেই বলল, মাকে কিন্তু আমরাই কক্ষনো সাদা শাড়ি পরতে দিই না।
লোকনাথবাবু মাথা নেড়ে সায় দিলেন শুধু। প্রতিমার আর যাই হোক থান মানায় না। উন্মুখ হয়ে এবার ওই ছেলেকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন তিনি। কথাটা ঠোঁটের ডগায় এসে গেছল, এবারে তোমার বাবার নাম বলো, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না।…দরকারও নেই, সবই বুঝতে পারছেন।
হাসিরানী বউদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে কি ইশারা করতে তারা চলে গেল। এই ইশারাটা লোকনাথবাবুও বুঝলেন। চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করতে বলা হল।
বাধা দিতে চেষ্টা করলেন, আমি এখন কিছু খাব না–
হাসিমুখে একটু দুলিয়ে দুলিয়ে মাথা নাড়ল হাসিরানী। আঠেরো বছর বয়সেও মাথা নাড়তে হলে ঠিক যেমনটি করত। অর্থাৎ বলতে চাইল, তা হয় না।
…কর্তাদের চকমিলানো দালান থেকে আঠারো বছরের বোবা মেয়ে হাসিনী হারিয়ে গেছল একদিন। হারিয়ে যায়নি, সকলেই ধরে নিয়েছিল প্রকারান্তরে সে। আত্মঘাতিনীই হয়েছিল। নিখোঁজ হবার আগের দিনও বিপদের স্পষ্ট হুশিয়ারী এসেছিল। আর সেটা উপেক্ষা করেই সে মরণ বরণ করেছিল।
..আর বিশ বছরের বি-এ পরীক্ষা দেওয়া এক ছেলে ভেবেছিল, দুঃখে অপমানে তার জন্যই মেয়েটা প্রাণ খোয়ালে। তার আত্মহত্যার সামিল কাজ করার জন্য সে-ই দায়ী। তেত্রিশ বছর আগে সেই ছেলেটা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছল।
সেই ছেলে লোকনাথ মিত্র।
সে-সময়ে বুড়োকর্তার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে হাসিরানী। বাঘের থাবায় পচন ধরে- যে ছেলে প্রাণ খুইয়েছিলেন তাঁর।
মেয়েটার হাসি দেখেই বুড়োকর্তা তার নাম হাসিরানী রেখেছিলেন বোধহয়। লোকনাথ, খুড়তুতো ভাই মন্মথ, আর বুড়োকর্তার নাতিরা আর এই নাতনী একসঙ্গে পাশাপাশি বড় হয়েছে। দু বছর বয়সে হাসিরানীর টাইফয়েড না কি মরণাপন্ন ব্যাধি হয়েছিল। তখন ও রোগের চিকিৎসা নেই। বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। কিন্তু বাচল শেষ পর্যন্ত। কথা বলার মধ্যে সেই দু বছর বয়সেই কেমন একটু জড়তা ছিল। মেয়েটার। সেই কথা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। কথা বলতে চেষ্টা করলে মুখ দিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ বেরুতে শুধু।
ওর পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা সেই বাঘের ক্ষত নিয়ে ফিরে এলেন। সঙ্গে ছিল বিশ্বাসী আর দুরন্ত সাহসী চাকর কিষণচাঁদ। চাকর বলা ঠিক হবে না, আসলে সে ছিল বড়বাবু অর্থাৎ বড় ছেলের শিকারের অন্তরঙ্গ সঙ্গী। কিষণচাঁদ হুবহু বাঘের ডাক ডেকে বাঘকে ভুলিয়ে কাছে নিয়ে আসতে পারত। আরো অনেক রকম ডাক ডেকে জন্তু-জানোয়ারকে ঘাবড়েও দিতে পারত। বড়বাবুর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে সেই কিষণচাঁদ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছিল। তার একটা মাত্র ছেলে, বছর চৌদ্দ বয়েস, বাপের মতোই ষণ্ডামার্কা হবে বড় হলে বোঝা যেত। তার নাম মগন, সে বাবুদের বাড়ীর ফাই-ফরমাস খাটত। কিষণ মরে যেতে মগনকেও বুড়োকর্তা সস্নেহে কাছে। টেনে নিয়েছিলেন। একই অঘটনে বড়বাবুও চোখ বুঝতে বুড়োকর্তার হুকুমে মগনের কাজ হল তার বোবা মেয়েটার দেখাশুনা করা, তাকে খেলা দেওয়া।