এ-হেন সহযাত্রী আর যাই হোক অবাঞ্ছিত নন। তাছাড়া ভদ্রলোক কথা বেশি বলেন না, তার থেকে ঢের বেশি মিটিমিটি হাসেন। তখন তার খুশি-খুশি ফোলা গাল দুটোকে টসটসে রসালো মনে হয়। লক্ষ্য করেছি তার কথায় সোজা সায় দিলে তিনি সেটা চাটুকারিতা ভাবেন, কিন্তু প্রতিবাদ করে শেষে যুক্তি খুঁজে না পেয়ে হার মানলে তুষ্ট হন। হিরু গুপ্তের আচরণে এই বৈশিষ্ট্যটুকুই লক্ষ্য করেছি। প্রতি কথায় প্রথমে বাধা দিয়ে পরে স্বীকার করবে, তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমি আগে বুঝিনি, বা এদিকটা খেয়াল করিনি, ইত্যাদি।
পাঠানকোট সকালে ছাড়ে, পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় লক্ষ্ণৌ পৌঁছায়। অতএব আমাদের গোছগাছ নিয়ে তাড়ার কিছু ছিল না। কিন্তু গাড়িটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুমদার মশাই উঠে দাঁড়িয়ে বার্থগুলো একনজর দেখে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওপরে না নীচে?
আমি জবাব দেবার আগেই হিরু গুপ্ত মন্তব্য করেছে, ওনার নীচের বার্থ হলেই সুবিধে হয় বোধহয়, কিন্তু…
কিন্তুর দিকে না গিয়ে তাড়াতাড়ি বলেছি, না না, ওপরের বার্থে আমার একটুও অসুবিধে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে সামনের মহিলার দিকে চোখ গেছে। তার নির্লিপ্ত মুখভাব। নীচের আর একখানা বার্থ তার দখলে থাকবে জানা কথাই।
মৃদু হেসে মজুমদার মশাই নিজের হাতে আমার বেডিং খুলতে গেলেন। তার উদ্দেশ্য বোঝার আগেই হিরু গুপ্ত হাঁ-হাঁ করে উঠল, আহা, ওঁর বিছানা পরে করে দেওয়া যাবে- সর্বব্যাপারে তোমার ব্যস্ততা
পরে নয় এখনই করে দে তাহলে। আর ওই বার্থে তোরটাও পেতে ফেল –সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম না হলে আমার অস্বস্তি।
আমি কিছু বলার ফুরসুত পেলাম না। হিরু গুপ্ত অপ্রসন্ন মুখে আমার হোলড অলটা টান মেরে খুলে ফেলল। অতএব ব্যস্ত হয়ে আমিও তার সঙ্গে হাত লাগালাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার ফিটফাট শয্যা রচনা হয়ে গেল। এরপর দ্বিতীয় বাংকে সে নিজের তকতকে শয্যা বিছালো, তারপর নেমে এসে বলল, এবার তোমাদেরটাও শেষ করে যে যার শুয়ে পড়া যাক।
অল্প হেসে মজুমদার মশাই বললেন, আমাদেরটা এখন কি, বসতে হবে, খাওয়া দাওয়া সারতে হবে
বলতে বলতে ঝুঁকে বড় ট্রাংকটা খুলে দুটো ঝকমকে গালচে বার করলেন।–নীচে আপাতত এই দুটো বিছিয়ে দে।
নীচের গদি-আঁটা বেঞ্চদুটোয় শৌখিন গালচে বিছানো হল। এ ব্যাপারে দেওরের সঙ্গে মহিলা নিজেও হাত লাগালো। তারপর জিনিসপত্রগুলোও জায়গামত গোছগাছ করে রাখল। এই সামান্য কাজটুকু দেখেই আমার কেমন মনে হল, মহিলার রুচিবোধ আছে। তাছাড়া ওপরে বিছানাপত্র সুবিন্যস্ত করা আর নীচে গালচে দুটো পেতে অন্য। জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখার পরে ছোট কামরাটার শ্রীই বদলে গেল। ধপ করে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে ঈষৎ অপ্রতিভ মুখে হিরু গুপ্ত মন্তব্য করল, সত্যিই এখন ভালই তো লাগছে দেখি।
তোষামোদটুকু যার উদ্দেশ্যে তিনি অর্থাৎ মজুমদার মশাই সেটা স্মিতহাস্যে গ্রহণ। করে আমার দিকে ফিরলেন।–বসুন, এখন কি খাবেন বলুন?
এবারও হিরু গুপ্ত আগেই তড়বড় করে উঠল, এই তো খেয়ে বেরুনো হল সবে, এখনই আবার খাওয়া কি!
আমিও সায় দিলাম, যাক খানিকক্ষণ।
মজুমদার মশাই স্ত্রীর উল্টোদিকের আসনে গা ছেড়ে দিয়ে বসলেন। ঠোঁটের ফাঁকের হাসির অর্থ–দেখা যাক কতক্ষণ কাটে।
এবারে দ্বিতীয় সহযাত্রী হিরু গুপ্তর প্রসঙ্গ। আধময়লা লম্বাটে চেহারা। নাকের ডগা একটু থ্যাবড়া, চোখ দুটো মন্দ নয়, কিন্তু চাউনিটা বেশ প্রখর। এ চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ওর মাথার মধ্যে সর্বদাই কিছু একটা জল্পনা-কল্পনা চলছে, সেই কারণে ওর মনটা যথার্থ স্থানে যেন প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নয়। ফলে চাউনির মধ্যে এক ধরনের ধারালো সংশয়ের ছায়া।
সহযাত্রী হিসেবেও একে কোন শ্রেণীতে ফেলব বলা শক্ত। কারণ কথা যখন বলে অনর্গল বলে যেতে পারে। আবার যখন চুপ করে থাকল একেবারে চুপ। হাবভাব ছটফটে গোছের। আজ নয়, আগেও মনে হয়েছে ওর ভিতরে কিছু একটা অসহিষ্ণুতা দানা বেঁধে আছে। সেই ঝোঁকে চলে, সেই ঝোঁকে কথা বলে। বড়বাবুর সে ডান হাত, ইউনিটে স্বভাবতই তার অখণ্ড প্রতাপ।
আমার সঙ্গে এর প্রথম আলাপ ছবির এই গল্প নিয়েই। এ গল্প নির্বাচনের ব্যাপারে সে-ই যে প্রথম উদ্যোক্তা এটা সে গোড়াতেই আমার কাছে জোর গলায় জাহির করেছে, দাদা কি সহজে বুঝতে চায় মশাই, নাকি এসব হাই জিনিস সহজে তার মগজে ঢোকে। ঠেসে ঢোকাতে হয়েছে মশাই, বুঝলেন? এ-জন্য ডিরেক্টরকে পর্যন্ত আগেভাগে হাত করতে হয়েছে। গল্প পড়ে তিনি টলতে দাদা ঢলল। গল্পটা ভাল করে মাথায় ঢোকার পরে অবশ্য দাদার উৎসাহ সকলকে ছাড়িয়েছে। আমার অবিশ্বাসের কারণ নেই, কারণ কি ছবি উনি আগে করেছেন দেখেছি। ভিতরে ভিতরে হিরু গুপ্তর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দিনকয়েক বাড়িতে আসার ফলে বেশ খাতির হয়ে গেছল। সেই খাতির জমাট বেঁধে গেল কিছুদিন আগের এক সন্ধ্যায়। সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে এর জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিলাম। কারণ সেই দিন আমার এই ছবির গল্পের পুরো দাম অর্থাৎ বেশ কয়েক হাজার টাকা প্রাপ্তিযোগ আছে।
নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে হিরু গুপ্ত এলো। আশা করেছিলাম ফাইনাল লেনদেনের ব্যাপারে তার দাদাও আসবেন। কিন্তু গাড়ি থেকে হিরু গুপ্ত একাই নামল।