এই জেরার মধ্যে পড়ে ছেলেগুলো বিরক্ত যেন। ওই বড় ছেলেই জবাব দিল, মা-কে আমরা মা বলেই জানি, নাম-টাম জানি না।
অবাক ব্যাপার। এত বড় বড় ছেলেরা মায়ের নাম জানে না, এও কি বিশ্বাস্য!
তুমি ছেড়ে আবার আপনি করে বললেন লোকনাথবাবু। ব্যাপার-গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না তার।–আপনাদের বাবার নাম কি?
এবারে বড় ছেলেটা স্পষ্টই বিরক্ত।-দেখুন, কোনো কথা না বলে মা আপনাকে শুধু নিয়ে যেতে বলেছেন- আপনি নির্ভয়ে গাড়িতে এসে উঠুন, আবার আপনাকে আমরা পৌঁছে দিয়ে যাব।
মনের ভাব চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, গিয়ে আবার ফিরতে কতক্ষণ লাগবে?
–যেতে-আসতে বড়জোর সোয়া-ঘণ্টা, তারপর মা যতক্ষণ আটকে রাখেন আপনাকে।
তার মানে কম করে দু ঘণ্টা। এখনই পাঁচটা বাজে, শীতের আলোয় টান ধরেছে। মাথা নেড়ে বললেন, আমি এখন যেতে পারছি না, এখানে নতুন মানুষ আমি, আপনার মা-কে বলবেন–
–দেখুন, আপনিই মিছিমিছি দেরি করছেন। মায়ের হুকুমে আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। তিনি নিয়ে যেতে বলেছেন, আমরা নিয়ে যাব। আপনি দয়া করে গাড়িতে উঠুন।
বিনীত কথাগুলোর মধ্যে এমনই একটা দৃঢ়তার সুর যে ভিতরে ভিতরে বিষম অস্বস্তিবোধ করলেন লোকনাথবাবু। এই নির্জনে জোর করে জীপে টেনে তুললেই বা কি করতে পারেন তিনি! সকলের মুখের দিকেই তাকালেন একবার। এই অযথা বিলম্ব ওরা কেউ পছন্দ করছে না।
দুর্গা নাম নিয়ে জীপের দিকে এগোলেন। তা ছাড়া তার ক্ষতিই বা কি হতে– পারে? তেত্রিশ বছর বাদে এখানে এসেছেন, ক্ষতি করতে খামোখা কেউ চেষ্টাই বা করবে কেন? নথ-পরা একজন রমণী যে ঝুঁকে দেখছিল তাকে, আর এরা এসে নামটাও তো ঠিকই বলেছে।
ওই বড় ছেলে এবারে নির্বাক অথচ সাদর আপ্যায়নে তাঁকে এনে ড্রাইভারের পাশে বসালো। নিজে চালকের আসনে বসল। পরের তিন ছেলে পিছনে।
জীপ ছুটল।
যে গতিতে ছুটল তাতেই ভয় ধরে গেল লোকনাথবাবুর। মাইলের কাটা পঞ্চাশের দাগ ছুঁয়েছে। এই স্পীডে যেতে-আসতে সোয়া-ঘণ্টা লাগলে কম করে পঁচিশ-তিরিশ মাইল যেতে হবে এখন।
আবার ভয়ানক অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন তিনি।
আধ ঘণ্টা বাদে একটা পাহাড়ের কাছাকাছি ফাঁকা জায়গায় সুন্দর একটা কাঠের বাংলোর সামনে জীপ এসে দাঁড়াল। পাশেই কাঠের স্তূপ আর একটা কাঠ-কাটা-কলের শেড চোখে পড়ল। বাংলোর বারান্দার রেলিং-এ দুটি অল্পবয়সের বউ দাঁড়িয়ে, আর দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করছে।
এইখানেই জীপ দাঁড়াল যখন, অনেকখানি নিশ্চিন্ত বোধ করলেন লোকনাথবাবু। যাক, কোনো একটা সংসারের মধ্যেই এসে পড়েছেন তাহলে তিনি!
ছেলেরা তাকে আপ্যায়ন করে বাংলোয় এনে তুলল। সেখানেই বসার সুন্দর চেয়ার-টেবিল পাতা। দুদিকে চমৎকার বাগান। অনেক রকমের ফুল ফুটে আছে। এই গৃহস্বামী-গৃহস্বামিনীদের রুচি আছে।
বড় ছেলে হাঁক দিল, মা কোথায়? উনি এসেছেন–
অল্পবয়সী বউ দুটি ভিতরে ঢুকে গেছে। ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে আর মেয়েটা অবাকবিস্ময়ে আগন্তুককে দেখছে।
ভিতরের দরজার কাছ থেকেই বড় ছেলের হাসি আর কথা শোনা গেল।–আরে না–আমরা কোনরকম জোর-জবরদস্তি করিনি–বাইরের দিকে মুখ বাড়ালো সে–আচ্ছা মশাই, আমরা আপনার সঙ্গে কোনরকম অভদ্র আচরণ করেছি?
ঘুরে তাকিয়ে লোকনাথবাবু মাথা নাড়লেন। ছাপাশাড়ির আভাস পেলেন, কিন্তু মুখ দেখতে পেলেন না। ছেলেটি তাকেই বলছে কথাগুলো।
রমণীটি এগিয়ে এলো। মাথায় ঘোমটা, নাকে বড় নথ, বয়সের দরুন সামান্য মোটার দিক ঘেঁষা, মুখের দিকে ভালো করে তাকান নি কিন্তু অবয়ব দেখেই বোঝা গেল খুব ফর্সা রং।
একেবারে চেয়ারের কাছেই এগিয়ে এলো সে, মাথার ঘোমটা অনেকখানি সরে গেছে তখন। তার একপাশে ওই অল্পবয়সী বউদের একটি। ছেলেরা চারজনই সামনে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু রমণীর মুখে একটিও কথা না শুনে সংকোচ কাটিয়ে মুখ তুলে তাকালেন লোকনাথবাবু। আর তারপরেই মাথাটা ঘুরে গেল কেমন। এই বাংলোটাই যেন প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছেন–স্বপ্ন দেখছেন কি সত্যি, ভেবে পাচ্ছেন না!
তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছে একটি রমণী। সেই হাসি তার সমস্ত মুখে, এমন কি কানের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। হাসলে গালের এক দিকে বড় একটা টোল পড়ে, তাই পড়েছে। সেই টোলের ভিতর দিয়েও যেন হাসি ঠিকরোচ্ছে। নিঃশ. এরকম হাসি একজনই হাসতে পারত, একজনেরই ওরকম হাসি সমস্ত মুখের রেখায় রেখায় ছড়াতো, কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে যেত, মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠত।
নিজের অগোচরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লোকনাথবাবু। অস্ফুট বিস্ময়ে বলে উঠলেন, হাসিরানী।
নিঃশব্দ হাসিটা যত বাড়ছে ততো যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে মুখ। গালের টোলে ততো বেশি খাঁজ পড়ছে। সেই হাসির একটু ছোঁয়া যেন ছেলেদের মুখেও লেগেছে। তারা অল্প অল্প হাসছে আর দুজনকেই নিরীক্ষণ করছে। বউটিও তাই।
-হাসিরানী তুমি! তুমি এখানে!
চোখের দিকেই চেয়ে আছে, তেমনি হাসছে। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল– সে-ই বটে। পদ্মহাতের মতো একখানা হাত তুলে তাকে বসতে বলল।
নিজেও সামনাসামনি চেয়ারের একটাতে বসল। তখনো মুখ লাল। হাসি মিলায়নি। হাসি চুয়ে পড়ছে।
বউটি তার চেয়ারের হাতলের কাছে দাঁড়াল। একটা চেয়ার টেনে বড় ছেলে একেবারে মায়ের গা ঘেঁষে বসল। রমণী তার দিকে ফিরে একটুও শব্দ না করে ঠোঁট নাড়ল। হাসছে তখনো।