এখানে এসে বয়েস ভুলে গেলেন লোকনাথবাবু। সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিতে দুই চোখে সেই আগের দিনের তৃষ্ণা উপচে উঠল। তিতিরে জলের ওধারে প্রায় দেড় মাইল পর্যন্ত ধু-ধু বালুর চর। তার ওধারে ঘন জঙ্গলের রেখা। তারও ওধারে। সারি সারি বিচ্ছিন্ন পাহাড়।
…আগে হামেশাই লোকনাথবাবু শুকনো চর পার হয়ে ওই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতেন। দুপাশের জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে আগে পায়ে-হাঁটা-রাস্তা ছিল। এখন কি হয়েছে জানেন না। জঙ্গলের ধারে ধারে আদিবাসী গরীবদের বসতি ছিল। সেগুলো গাছের আড়ালেই ছিল বলে আগেও এত দূর থেকে দেখা যেত না। কর্তাদের ইজারার জঙ্গল এদিকে নয়–সেটা পশ্চিমে! দেবরায়দের সেই চকমিলানো বাড়ির এক-আধ মাইলের মধ্যেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। তাদের জঙ্গলও সেইদিকেই ছিল, তবে বহু দূরে। দেবরায়দের ওই বাড়ির ছাদে উঠে লোকনাথবাবু একমনে দাঁড়িয়ে সেদিকের জঙ্গলও দেখতেন। কিন্তু তার সব থেকে ভালো লাগত এ-দিকটা–এই সোনালীর দিকটা।
জুতোজোড়া হাতে নিয়ে লোকনাথবাবু সাগ্রহে সোনালী পেরিয়ে ওদিকের চরে গিয়ে উঠলেন। তারপর ওই জঙ্গল আর পাহাড়ের দিকে চোখ রেখে চলতে লাগলেন। তেত্রিশ বছর বাদে আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে এসেছেন যেন তিনি। মনের আনন্দে এগিয়ে চললেন।
চর শেষ হল। এদিকটায় জলের রেখাও নেই আর। লোকনাথবাবু ওপারের ডাঙায় গিয়ে উঠলেন। দূর থেকে বনের লাইন যেমন নিচ্ছিদ্র মনে হয় তা নয়। তেত্রিশ বছর আগে যেমন দেখেছিলেন, এ-দিকটায় তার থেকে অন্তত ঢের উন্নতি হয়েছে। বনের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। গাছ-গাছড়ার আড়ালে বেশ সুন্দর কাঠের বাড়িও দেখা গেল গোটাকতক।
ঘন বন একপাশে রেখে আপনমনেই হাঁটতে লাগলেন। জঙ্গলে হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে, লোকালয়ের দিকটায় তাদের পদার্পণ ঘটার কথা নয়।
একটা জীপ পাশ কাটিয়ে গেল। ড্রাইভারের পাশে একজন বয়স্কা রমণী বসে। পরনে ছাপাশাড়ি, মাথায় ঘোমটা। এক নজর তাকিয়ে বাঙালী মনে হল না। লোকনাথবাবুর। কারণ নাকে বড়সড় একটা সোনার নথ। কিন্তু অবাক কাণ্ড, জীপের। গতি শিথিল হল, আর সেই রমণী তার আসন থেকে ঝুঁকে পিছনের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখতে লাগল।
তিনি খানিকটা এগিয়ে আসতে প্রায়-থামা জীপটা হঠাৎ স্পীড বাড়িয়ে চলে গেল। নথ-পরা রমণীর ফর্সা গোলগাল মুখ, কিন্তু মুখের আদল লক্ষ্য করার সুযোগ হয়নি লোকনাথবাবুর। ভাবলেন, হয়তো কোনো চেনা লোক ভেবেছিল রমণী, চেনা নয় দেখে চলে গেল।
নিজের মনে আরো অনেকখানি এগিয়ে গেলেন লোকনাথবাবু। পাশের বন ক্রমে গম্ভীর হয়ে উঠছে, অন্যদিকে লোক-বসতির আভাস আর চোখে পড়ছে না। আদিবাসীদের কুঁড়েঘরের বসতি দেখেছেন। এখন আর তাও চোখে পড়ছে না।
এত পথ এভাবে হেঁটে এসে ভালো করেন নি, লোকনাথবাবু ফিরলেন। একটু তাড়াতাড়িই পা চালালেন। যতটা এসেছেন, সোনালীর চরে পৌঁছুতে কম করে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে।
কাছাকাছি এসে গেছেন, আর শতখানেক গজ পথ শেষ হলেই সোনালীর চরের সামনে পৌঁছবেন। চকিত হয়ে পিছন ফিরে তাকালেন। একটা জীপ তীরের মতো এদিকেই ছুটে আসছে- তারই শব্দ। সেই জীপটাই কিনা বুঝলেন না। বাঁধানো হলেও সরু রাস্তা। অত স্পীডে আসতে দেখে লোকনাথবাবু বিরক্ত হয়েই পাশ দেবার জন্য একধারে সরে দাঁড়ালেন।
কিন্তু আশ্চর্য, একটু বাদে জীপটা তার পাশেই ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে গেল। হ্যাঁ, আগের সেই জীপই। কিন্তু এতে ড্রাইভারের পাশে রমণীর বদলে অন্য একটি অল্প বয়সী লোক। আর জীপের পিছনে আরো দুটি ছেলে।
চারজনই জীপ থেকে নেমে এলো। তাদের পরনে পরিষ্কার ট্রাউজার আর গায়ে টেরিকটের হাফ-শার্ট। চারজনেরই মুখের আদল একরকম। দেখলেই মনে হবে চার ভাই। কালোর ওপর বেশ মিষ্টি চেহারা। টানা চোখ। সব থেকে আগে চোখে পড়ে স্বাস্থ্যসম্পদ। ওই দুটো করে বাহু যেন দুনিয়ার অনেক শক্তি কেড়ে নিতে পারে।
চারজনই এগিয়ে এসে হাত কপালে ঠেকিয়ে সবিনয়ে নমস্কার করল তাকে। লোকনাথবাবুও বিমূঢ় মুখে প্রতি-নমস্কার জানালেন। এদের মধ্যে সকলের বড়টির বছর বত্রিশ বয়েস হবে, আর সকলের ছোটর বছর পঁচিশ। ওই বড়জনই জীপ চালাচ্ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম লোকনাথ মিত্র?
বিমূঢ় মুখে লোকনাথবাবু মাথা নাড়লেন– নামটা তারই বটে।
-আপনাকে একবারটি আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।
লোকনাথবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।–কোথায়?
–জীপে গেলে খুব বেশি দূর নয়, আপনি কিছু ভাববেন না, আপনাকে আবার আমরা পৌঁছে দেব।
লোকনাথবাবু ভেবাচাকা খেয়ে গেলেন। আমি তো আপনাদের চিনি না, কোথায় যেতে হবে? কেন যেতে হবে?
–আমাদের মা একবারটি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।
–আপনাদের মা! আপনাদের মা কে?
ছেলেটা হাসল। হাসিটা মিষ্টি। জবাব দিল, মা মা-ই, আসুন!
লোকনাথবাবু ফাঁপরে পড়লেন। বললেন, আমি তো এখানে কাউকেই চিনি না বহুকাল বাদে এদিকে এসেছি, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে, আমাকে কেউ এখানে ডাকতে পারেন না।
ছেলেটা গম্ভীর হঠাৎ। অন্য সকলেও।
বলল, মায়ের ভুল হয় না।–ঘণ্টাখানেক আগে এই জীপে করে যাবার সময় মা আপনাকে দেখেছেন, তাছাড়া আপনার নাম করেই তো আপনাকে নিয়ে যেতে হুকুম করেছেন?
তাও তো বটে।-নথ-পরা সেই রমণীই এদের মা তাহলে! আপনি ছেড়ে এবারে তুমি করে বললেন লোকনাথবাবু।–তোমাদের মায়ের নাম কি?