পায়ে পায়ে ঘাটের দিকে এলেন লোকনাথবাবু। চোখে কাটা বিঁধল যেন। চারদিক জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল ছিল, এখন সেই জল একেবারে তলায় এসে ঠেকেছে-তার ওপর যেন সবুজ সর পড়ে আছে একটা। দেখলেই বোঝা যায় কেউ আর এখন এই জল ছোঁয় না। বাঁধানো সিঁড়িগুলোও ভেঙে ফেটে চৌচির হয়ে আছে।
লোকনাথবাবু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, কি ব্যাপার, দেবরায়দের কোনো বংশধরও আর এখানে থাকে না?
মন্মথর বড় ছেলের নাম সুবল। সে বলল, না, মাত্র বছর পাঁচেক আগে বাড়ি-ঘর, বিষয়আশয় সব বেচে দিয়ে তারা এখান থেকে চলে গেছেন। এই বাড়ি আর জায়গা-জমি কি সব কাজে লাগানো হবে বলে সরকার কিনে নিয়েছিল, কিন্তু কিছুই হয় নি, তেমনি পড়ে আছে।
–মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এই দশা?
সুবল বলল, খারাপ দশা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল–ভাগের মা গঙ্গা পায় না, বাড়ি-ঘরদোর কে দেখে! কর্তাদের দুভাইয়ের মিল ছিল খুব, দুজনে একসঙ্গেই নেশা-টেশা করত, কিন্তু তাদের ছেলেদের মধ্যে বনিবনা ছিল না একটুও-বউদের মধ্যেও না। তবু কর্তারা বেঁচে ছিলেন বলে তখনো খাওয়া-খাওয়ি শুরু হয়নি, আর ব্যবসাপত্রও চালু ছিল। ছেলেপুলেসুদ্ধ সেই ডাকাতের হাতে পড়ার পর রাতারাতি অতবড় ব্যবসা অর্ধেক হয়ে গেল, তারপর কিছুদিনের মধ্যে
লোকনাথবাবু অবাক।–ছেলেদেরসুদ্ধ কর্তারা ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন নাকি? কোথায়?
সুবল সোৎসাহে বলল, ও, আপনি তো কিছুই জানেন না–সে এক তাজ্জব কাণ্ড! সেও বছর ছয় আগের কথা, মাসে তখন বুড়ো কর্তারা একবার করে জঙ্গলে যেতেন আদায়পত্র দেখাশুনা করতে। নেশার কল্যাণে তখন ইজারার একটা জঙ্গলই হাতে ছিল, কাদের সঙ্গে তাদের ছেলেরা থাকতেন।
একবার ওমনি জঙ্গলে গিয়ে তিন দিন বাদে ছেলেদের কোথায় রেখে শুধু কর্তা, দুই ভাই ফিরে এলেন। তাদের সে মুখের দিকে তাকানো যায় না, যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে মাথার ওপর দিয়ে। দুজনের দুই-দুই চার ছেলেকে কোথায় রেখে এলেন কেউ জানে না। ফিরে এসেই অত বড় ব্যবসার অর্ধেকই বেচে দিলেন তারা–আর কাউকে সঙ্গে না নিয়েই আবার জঙ্গলে ছুটলেন। তার পরদিনই অবশ্য কর্তাদের সঙ্গে তাদের চার ছেলেও ফিরলেন–কিন্তু ছ মাসের মধ্যে কি ব্যাপার কেউ একটি কথাও জানল না।
ছ মাস বাদে সরকারের কাছে এই সব কেচে এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে ব্যাপারটা জানাজানি হল। যাবার আগে পুলিসের কাছে একটা রিপোর্টও করে গেলেন না তারা এটাই আশ্চর্য। জঙ্গল থেকে ফেরার সময় ওই চার ছেলেসহ দুই কর্তা ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। জঙ্গলের ধারেকাছে ডাকাত আছে এমন খবর কেউ কখনো শোনেনি। সেই ডাকাতের দল নাকি তাদের ধরে বহু দূরে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে তুলেছিল–যাবার সময় মোষের গাড়িতে সক্কলের চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে। তারপর বহু হাজার টাকা ছেলেদের মাথার বিনিময়ে মুক্তিপণ হেঁকে চোখ বেঁধে শুধু বুড়ো কর্তা দুজনকে জঙ্গলের বাইরে এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে। টাকা। দেবার জন্য পাঁচটি দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের–তার মধ্যে জঙ্গলে টাকা না নিয়ে এলে বা কোনরকম চালাকি খেলতে গেলে চার ছেলেরই মৃতদেহ সোনালীর জলে ভাসবে বলে শাসিয়ে দিয়েছে। টাকা নিয়ে ঠিক দিনে তারা জঙ্গলে গেলেই বাদবাকি ব্যবস্থা তারা করবে।
টানা প্রায় ছমাস কর্তাদের ছেলেরা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। তাছাড়া বাপেরাই হয়তো ছেলেদের কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে থাকবেন। কিন্তু সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাবার আগে তাদের ভয় ভেঙে গেছল। ছেলেরাও মদের নেশায় পোক্ত হয়ে উঠেছিল, সেই মদের ঝেকেই তারা সব ফাস করে দেয়। তারা নাকি খুব ভালো করেই জানে, ওই ডাকাত দলের সর্দারণী একজন মেয়েছেলে। তারা তাকে দেখেনি, কিন্তু টের পেয়েছে।
ঘটনাটা শুনে বেশ অদ্ভুতই লাগল লোকনাথবাবুর। পাহাড়ে জঙ্গলে ডাকাতের উৎপাত হতে পারে, যদিও আগে এ-রকম ঘটনার কথা কখনো শোনা যায়নি। আর আগে থাকতে খবর নিয়ে আঁটঘাট বেঁধে যদি ডাকাতেরা কাজে নেমে থাকে–তাহলে মুক্তিপণ হাঁকাটাও অসম্ভব কথা কিছু নয়। কিন্তু ভয়ের চোটে ঘটনার ছমাস বাদেও এঁরা কাউকে কিছুই বলেননি সেটাই আশ্চর্য। হয়তো বা ডাকাতরা শাসিয়ে রেখেছিল, পরেও কাউকে কিছু বললে আর এ নিয়ে পুলিশের তত্ত্ব-তল্লাসী চললেও তাদের গর্দান যাবে।
লোকালয় ছাড়িয়ে মাইল দুই হাঁটলে সোনালী নদী। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ পায়ে পায়ে সেই দিকে চললেন লোকনাথবাবু। এই এলাকাটাই একসময় সব থেকে প্রিয় ছিল তার। স্কুল-কলেজের বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত এখানে এলে এদিকটাই সব থেকে বেশি চষে বেড়িয়েছেন তিনি।
শীতের অপরাহ্নের মিঠে রোদ, হাঁটতে ভালো লাগছে। এদিকে পা বাড়ানোর পর আরো ভালো লাগছে। তৃষ্ণার্ত দুই চোখ মেলে সোনালীর দিকে এগিয়ে চলেছেন। নদীর দুদিকে সোনার মতো ঝকঝকে বালুর চর–এই জন্যেই নদীর নাম সোনালী বোধ হয়।
দূর থেকে লোকনাথবাবু হতাশ হলেন একটু। সবকিছুর মতো সোনালীও বুড়িয়ে গেছে মনে হল। নদীর দুদিকে চরের পরিধি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে মনে হল। কাছে এসে দেখলেন সোনালী অর্ধেক সরু হয়ে তিরতির করে বইছে এখনো, সেই জলে পায়ের পাতা ডোবে কিনা সন্দেহ।
শীতের সময় আগেও অবশ্য হাঁটুজলের বেশি গভীর ছিল না সোনালী। তবে চওড়া এর তিনগুণ ছিল। আর বর্ষায় তো এই সোনালীরই দুকূল ছাপানো সংহার মূর্তি। সুবল ওদের মুখে শুনেছেন, দূরের কোথায় বাঁধ হবার ফলে এখন নাকি বর্ষায়ও সোনালী আর তেমন ভরে ওঠ না।