এবারে আর রামকৃষ্ণবাবু জবাব দিলেন না। ভিতরে ভিতরে কেন যে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন জানেন না। পুরনো স্মৃতি সবই মুছে গেছল, তিরিশ বছর বাদে আবার সেটা তাজা করে তোলার ব্যাপারে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই। ভিতরে তার একটাই কৌতূহল। শুভ গাঙ্গুলীকে আজ তিনি এখানে এই বিজনে এ অবস্থায় দেখছেন কেন? অথচ কালো মুখের ওই হাসির সঙ্গে যেন সত্তার যোগ-পিছনে যা ফেলে এসেছেন। তার জন্যে যেন এতটুকু খেদ নেই, ক্ষোভ নেই।
প্রশ্নের সুযোগ মহিলাই দিলেন। বললেন, এতকাল পরে দেখা, আমার কোনো। খবর জিজ্ঞাসা করলে না তো?
–জিজ্ঞাসা করলে বলবে?
–ওমা, না বলার কি আছে!
–এই জীবনে অভ্যস্ত হতে তোমার কতদিন লেগেছে?
–বেশি দিন না। গানের কল্যাণে ভারী সহজেই সব সয়ে গেল।
–অর্থাৎ যার জন্যে তোমার এতখানি আত্মত্যাগ, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই তোমাকে ছেড়ে গেছেন?
জবাব দিলেন না। রামকৃষ্ণবাবুর আবার মনে হল, কালো মুখের তলায় তলায় আবার সেই বিচিত্র হাসির উৎসমুখ যেন খুলে গেছে। কালো ত্বকের ভিতর দিয়ে সেই হাসির তরঙ্গও বুঝি দুচোখ মেলে দেখার মতো।
-জবাব দিলে না! রামকৃষ্ণবাবু বললেন, তবু আরো একটু কৌতূহল আমার –আমাদের সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে যে মানুষটিকে সেদিন অনুগ্রহ করেছিলে তাকে কি আমি চিনি?
সমস্ত মুখেই হাসি চিকচিক করছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রামকৃষ্ণবাবুর। এবারে মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লেন মহিলা– অর্থাৎ চেনেন।
-নাম বলবে না বোধ হয়?
–বললে কি করবে, তিরিশ বছর বাদে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে ছুটবে?
–না, শুধু জানার ইচ্ছে। আর সত্যিই তুমি সুখী কিনা!
কালো মুখে সেই হাসির নিঃশব্দ তরঙ্গের ছেদ নেই। হাসিমাখা দুই চোখ তার। চোখের ওপর অপলক কৌতুকে স্থির হয়ে আছে। তেমনি মিষ্টি স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর মহিলার। বললেন, তার নাম রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী–যে ভদ্রলোক চোখ বুজে আমার গান। শুনত আর কল্পনার জোয়ারে ভাসত, যার গল্পের নায়িকারা সকলেই সুন্দরী, আর যে ভদ্রলোক আমাকে ছেড়ে আমার গানকে বিয়ে করার জন্য একেবারে ক্ষেপে উঠেছিল! আমি সরে এসে তাকে রক্ষা করতে পেরেছি, নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। –আমার মতো সুখী কে আছে!
মুহূর্তের মধ্যেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা তোলপাড় কাণ্ড ঘটে গেল বুঝি রামকৃষ্ণবাবুর ভিতরে ভিতরে। তারপর নির্বাক, নিষ্পন্দ, বিমূঢ়, একেবারে।
কালো মুখের হাসির আলো মিলায়নি একটুও। ঈষদুচ্চ স্নিগ্ধ গলায় ডাকলেন, লছমন!
স্থানীয় সেই লোকটি এগিয়ে এলো।
মহিলা সুন্দর হিন্দীতে বললেন, বাবুজী যাবেন এখন, অন্ধকার হয়ে আসছে, সঙ্গে গিয়ে টাঙ্গায় তুলে দিয়ে এসো।
কথার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, হাসির তরঙ্গ কমেছে, কিন্তু সমস্ত মুখে তার কমনীয় রেশ ছড়িয়ে আছে। বললেন, ভজনের সময় হল, আমার আর বসার জো নেই
যন্ত্রচালিতের মতো উঠলেন রামকৃষ্ণবাবুও। বিমূঢ় নেত্রে চেয়ে আছেন তেমনি। চোখে পলক পড়ে না।
…শুভ গাঙ্গুলী তিরিশ বছর আগে মুছেই গেছে।
সামনে যাকে দেখছেন তিনি মাতাজী।
বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন
আজও গ্রামই দেখবেন লোকনাথবাবু ভাবেননি।
তেত্রিশ বছর আগে বরং এই বর্ধিষ্ণু গ্রামে শহরের কিছু ছাঁদছিরি এসেছিল। এখানকার কাঠের ব্যবসা ফলাও হয়ে উঠেছিল। দূরের মানুষদের আনাগোনা বেড়েই চলেছিল। ফলে তখনই এর থেকে ঢের বেশি চেকনাই দেখা গেছল। তেত্রিশ বছর বাদে এখানে পা দিয়ে লোকনাথবাবুর কেবলই মনে হতে লাগল–সমস্ত গ্রামটা যেন ভয়ানক বুড়িয়ে গেছে আর আফিমখোরের মতো ঝিমুচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখানে দিনকতক কাটালে এখানকার জরা বুঝি তাকেও ঘেঁকে ধরবে।
অথচ দিনকয়েক এখানে থাকার বাসনা নিয়েই এসেছেন লোকনাথবাবু। জীবনের প্রথম বিশটা বছর এই জায়গার সঙ্গে নিবিড় যোগ তার। যদিও বছরের বেশির ভাগ সময়েই দূরের শহরে কাটাতে হত তাকে। এই দশা হলেও এখানে নাকি হাই স্কুল আছে একটা। তখন প্রাইমারী স্কুল ছিল। সেখান থেকে বৃত্তি পাওয়ার ফলে কাকা উদার হয়ে কাকীমার অমতে শহরের হাই স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন তাকে। কাকীমার। ইচ্ছে ছিল, নিজের ছেলেকেই শুধু শহরের স্কুলে পড়তে পাঠান, একসঙ্গে দুজনকে বোর্ডিং-এ রেখে পড়ানোর সংগতি কোথায়? ভাসুরপো বরং বাবুদের কাঠের গুদামে বা জঙ্গলের কাজে লেগে যাক।
কাকা অনেক কারণে চক্ষুলজ্জায় পড়েছিলেন। প্রথম কারণ, মরার আগে লোকনাথবাবুর বাবা কাকার হাতে কিছু টাকাকড়ি তুলে দিয়ে গেছলেন। আর মাতৃহীন ছেলেটাকে মানুষ করার আকৃতি জানিয়ে গেছলেন। দ্বিতীয় কারণ, কাকার আগে লোকনাথবাবুর বাবাই কর্তাদের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। বাবা অকালে মারা যেতে তার জায়গায় কাকা জাঁকিয়ে বসেছেন। এই কাকাকে বুড়ো কর্তামশাই খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। কিন্তু অতিবৃদ্ধ তিনি তখন, আর তার তিন ছেলের মধ্যে মেজ আর ছোটই সর্বব্যাপারে মাতব্বর তখন। বড় ছেলেই বাপের এত বড় কাঠের ব্যবসা আর জঙ্গল তত্ত্বাবধানের প্রধান সহায় ছিলেন। সেই ছেলে শিকারে বেরিয়ে বাঘের থাবার ঘা নিয়ে ফিরলেন। তারপর একটু একটু করে দেহ বিষিয়ে চোখ বুজলেন। সেই শোক তার বৃদ্ধ বাপ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলতে পারেন নি। লোকনাথবাবুর কাকা ওই ছোট দুই ছেলের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, একসময়। তাদের অনেক রকমের হুকুম তামিলের মানুষ ছিলেন। তাই লোকনাথবাবুর বাবা চোখ বুজতে কাকাকেই তার বাবার জায়গায় বসিয়ে দিলেন। সেই জায়গার গালভরা নাম হল ম্যানেজার। কিন্তু আসলে গোমস্তা। লোকনাথবাবুর বাবা বুড়ো কর্তার স্নেহের ভাগীদার ছিলেন, কিন্তু কাকা শুধুই গোমস্তা। মাইনে পঞ্চাশ টাকা। তেত্রিশ বছর আগে সেটা একেবারে কম কিছু নয়। কিন্তু বুঝে-শুনে চলতে পারলে আরো অনেক দিকে আয়ের পথ খোলা ছিল। সে-রকম বুঝেশুনে চলার বুদ্ধিও কাকার ছিল। তবু ভাইপোর বাবার জায়গায় তিনি বসেছেন, এটা বোধহয় ভুলতে পারেন নি।