–তীর্থে বেরোইনি আমি–মাদ্রাজ থেকে হঠাৎ ঘোরাঘুরির নেশায় পেয়ে বসেছে।
ভিতরটা ভয়ানক উসখুস করে উঠছে রামকৃষ্ণবাবুর। কৈফিয়ত চাইবার সময় আর প্রয়োজন বহুকাল আগে ফুরিয়েছে। এখন শুধু কৌতূহল একটু।…প্রতিশ্রুতি ভুলে, ভবিষ্যৎ ভুলে, গান ফেলে তিরিশটা বছর আগে শুভ গাঙ্গুলী হঠাৎ কার সঙ্গে ওভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছল, আর এখন সেই মানুষের খবর কি- ঠোঁটের ডগায় বার বার এই প্রশ্নটাই আসছে শুধু।
..তিরিশটা বছর অনায়াসে চোখের সামনে থেকে সরে গেছে রামকৃষ্ণবাবুর। তিরিশটা কেন, তারও ঢের বেশি।
. …ন’দশ বছর বয়েস থেকেই নিজের কালো কুৎসিত বয়েস সম্পর্কে সজাগ ছিল একটা মেয়ে। তার নাম শুভাশুভ গাঙ্গুলী। রামকৃষ্ণবাবুর দিদির ভাসুরের মেয়ে। মধ্যবিত্ত অবস্থার মানুষ। সেই কুৎসিত মেয়েটা এমন কিছু গুণের অধিকারিণী হতে চেয়েছিল, যার আলোয় রূপের খেদ ঢাকা পড়ে যেতে পারে।
…সেরকম গুণের অধিকারিণী হতে পেরেছিল। গান- চৌদ্দ বছর বয়সে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। তেইশ বছরের মধ্যে তার রেকর্ডের ছড়াছড়ি। বড় বড় সব জলসা থেকে ডাক আসে, সিনেমায় প্লে-ব্যাকের ডাক আসে। শেষের দুটো বছর রেকর্ড আর প্লে-ব্যাকের দরুন অবিশ্বাস্য টাকা এসেছিল সেই মেয়ের হাতে।
..আর যে ছেলেটার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে তার হৃদ্যতা, তার নাম রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। শুভার মা নেই, ভাসুর-ভাসুরঝির বাস দিদির কাছেই।…ওই মেয়ে তার লেখক জীবনের প্রথম প্রেরণা। তার সঙ্গে প্রতিটা লেখা নিয়ে কত আলোচনা, কত মতভেদ।
নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবেন স্থির করে ফেলেছিলেন রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী।
…বাইরেটা কুৎসিত কিন্তু ভেতর তো সুন্দর। চোখ বুজে গান শোনে যখন, স্থান কাল ভুল হয়ে যায়।…তা ছাড়া বয়সেরও একটা রূপ আছে, সেই রূপই চোখে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। শুভার গানের কদর চারদিকে যতো বাড়ছে–রূপের প্রশ্নটা ততো গৌণ ভাবতে চেষ্টা করেছেন রামকৃষ্ণ।
কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গে মেয়েটা হাসে শুধু। হাঁ-না কিছুই বলে না। কালো মুখে রঙের ছোপ লাগে সেটা অবশ্য রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর চোখ এড়ায় না। ওদিকে গানের টাকা আসছে–ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে- রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী অন্তত চারজনকে জানেন, যাদের যে-কোনো একজন শুভার একটু চোখের ইশারা পেলে বিয়ে করে তাকে সাদরে ঘরে তুলে নিয়ে যাবে। রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী ঠাট্টা করে ওদের নিয়ে। শুভ গাঙ্গুলী হাসে খুব। বলে, স্টুডিওতেও জনাতিনেক আছে যারা পাগল করে ছাড়লে!
মনস্থির করে ফেলার পরেও ওই মেয়ের সাড়া না পেয়ে ভিতরে ভিতরে রামকৃষ্ণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন। অথচ মেয়েটা যে তার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে সেই। আভাসও পেয়েছেন। গানের জন্যে যে মেয়েকে সাধ্যসাধনা করতে হয়, সেই মেয়ে নিরিবিলিতে তাঁকে দশখানা গান শোনাতেও আপত্তি করে না।
…ছেলেটার সাতাশ আর মেয়েটার তেইশে এক বিপর্যয় ঘটে গেল। ওই মেয়ে প্রশ্রয় না দিলেও প্রেমিকের সংখ্যা বাড়ছে দেখে ছেলেটার ইদানীং মেজাজ চড়া প্রায়ই।
বৃষ্টিতে কলকাতা ভেসে যাচ্ছিল সেই রাতে। দিদি-জামাইবাবু কোথাও বেরিয়ে আটকে গেছেন বোধহয়। তিনতলার ঘরে চোখ বুজে একের পর এক গান শুনে যাচ্ছিলেন রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। এক-একটা গান শেষ হলে শুভার চোখে চোখ মেলছিলেন। হঠাৎ উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল ছেলেটা। শুভার মুখে শংকা, চোখে বিস্ময়।–কি?
রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী এগিয়ে এলেন। খুব কাছে। তানপুরা সরিয়ে দিলেন। তারপর শক্ত দুই হাতে একেবারে বুকের ওপর টেনে আনলেন ওকে। আমাদের বিয়ে হবে কি হবে না?
– ছাড়ো, আঃ!
বাধা পড়ল। দুটো পুরু ঠোঁটের মধ্যে শব্দটা হারিয়ে গেল। অসহিষ্ণু তাড়নায় মেয়েটাকে, বুঝি গ্রাস করে ফেলবেন।–বিয়ে হবে কি হবে না?
সমস্ত মুখে বেগুনে রং শুভার। কাঁপছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। –কি করছ! ছাড়ো, কেউ এসে গেলে–
আবার আসুরিক বাধা পড়ল। তারপর আবার সেই প্রশ্ন। আমাদের বিয়ে হবে কি হবে না?
হাল ছেড়ে ওই মেয়ে কালো টানা-টানা দুই অসহায় চোখ তার মুখের ওপর রাখল।–হবে। ছাড়ো।
এই ঘটনার ঠিক পাঁচদিনের মাথায় ওই মেয়ে নিখোঁজ।…যে চারটে ছেলে তার প্রত্যাশায় বাড়িতে আসত, তাদের দেখা মিলেছে। রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী আর তাদেরও ধারণা, স্টুডিওরই কোনো একান্ত গুণগ্রাহীকে নিয়ে শুভ গাঙ্গুলী উধাও হয়েছে। দিদির মুখে শুনেছে, যাবার আগে ওই পাঁচদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে নিজের নামের সব টাকাও তুলে নিয়ে গেছে।
….তিরিশ বছর বাদে এই দেখা।
রামকৃষ্ণবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছ?
তেমনি হাসিমুখে মহিলা জবাব দিলেন, তোমাকেই দেখছি।… তিরিশটা বছর কেটে গেল, এ যেন বিশ্বাস হয় না, মনে হয় সব সেদিনের কথা। চোখ বুজে তোমার সেই গান শোনা আজও যেন চোখের সামনে দেখছি।
রামকৃষ্ণবাবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। পুরনো দিনের স্মৃতির শুধু এটুকুই চোখে ভাসার কথা নয়।
রমণীর কালো মুখে খুশিভরা কৌতুক।–আচ্ছা, তোমার বউ রূপসী ছিলেন নিশ্চয়?
–রূপসী না হোক, মোটামুটি ভালোই ছিলেন দেখতে। জবাবটা দিতে পেরে মনে মনে খুশী হলেন রামকৃষ্ণবাবু।
মুখ টিপে হাসছেন মহিলা। আবার কি মনে পড়ল হঠাৎ। মুখে সেই রকমই কৌতুকের মিষ্টি ছটা–আর তোমার পরের সব বইয়ের নায়িকারাও কি প্রায় সুন্দরী নাকি?