এ আবার কি বিড়ম্বনা রে বাবা! মাতাজী তাকে ডাকেন কেন? গানের সমজদার ভেবেছেন নাকি? চারদিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কঁহা মাতাজী?
মন্দিরের পিছনটা দেখিয়ে লোকটা তাকে রেলিংঘেরা চাতাল ধরে পিছনদিকে নিয়ে চলল।
লালপেড়ে শাড়িপরা সকালের সেই রমণী বসে। সোজা সামনের দিকে অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে মুখ। পিছন থেকে কালো দেহের আঁট-বাঁধুনী দেখে খুব বেশি বয়েস মনে হল না মাতাজীটির। ইনি ওখানে বসে রামকৃষ্ণবাবুর এইস্থানে আগমন টের পেয়ে লোকমারফৎ ডেকে পাঠালেন কি করে? হয়তো আসার সময় দেখে থাকবেন!
নমস্তে।
–নমস্কার। বোসো। বলতে বলতে তার দিকে ঘুরে তাকালেন মাতাজী।
সেই মুহূর্তে মাথার মধ্যে এই পৃথিবীটাই বুঝি উল্টেপাল্টে যেতে লাগল রামকৃষ্ণবাবুর। কিন্তু বাইরে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। বিস্ফারিত চোখে দেখছেন। দেখার পরেও বিশ্বাস করবেন কি করবেন না জানেন না।…তেইশ বছরের একটা মেয়ের মুখে চোখে সর্ব অঙ্গে তিরিশটা বছর জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায়? কেমন দাঁড়ায়? অথচ আশ্চর্য, এঁর সামনে এসে দাঁড়ালে, ভালো করে একটু তাকালে, তিরিশ বছর আগের সেই তেইশ বছরের মেয়েকে চিনতে একটুও সময় লাগে না। রামকৃষ্ণবাবুরও সময় লাগল না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
মাতাজী এবারে খানিকটা ঘুরেই বসলেন তার দিকে। হাসিমাখা স্নিগ্ধ মুখ।…তিরিশ বছর আগে ওই মুখে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা ছিল না, আজও নেই। কিন্তু সেদিনও মুখের হাসিটুকু ভালো লাগত, আজ সেটা স্নিগ্ধ কমনীয় লাগছে।
–চিনতে পারছ না?
দাঁড়িয়ে থাকার দরুন মাথার চুল আরো বেশি উড়ছে রামকৃষ্ণবাবুর। মাথা নাড়লেন। পারছেন।
সামনের ঝকঝকে মেঝে দেখিয়ে মাতাজী বললেন, তাহলে বোসো–সকালে রামেশ্বরের ঘাটে দেখার পর থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
বাহ্যজ্ঞানরহিতের মতো রামকৃষ্ণবাবু বসলেন। চেয়েই আছেন মুখের দিকে। এভাবে সামনে বসতে, মুখের দিকে চেয়ে থাকতে এ-বয়সে কোনো দ্বিধা বা সংকোচ থাকার কথা নয়। তার ওপর ইনি মাতাজী এখানকার। শ্রীরামচন্দ্রের চরণদর্শনে যারা আসছে, অলিন্দ ঘুরে তারা একবার মাতাজীকৈও দর্শন করছে–তফাতে দাঁড়িয়ে দুহাত জুড়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। হয়তো তাঁর নির্দেশেই মন্দিরের ভক্ত দুটি আপাতত কাউকে কাছে আসতে দিচ্ছে না।
মুখের ওই হাসি এখন আরো অদ্ভুত লাগছে রামকৃষ্ণবাবুর।… তার থেকে চার বছরের ছোট, অর্থাৎ তিপ্পান্ন হবে বয়েস এখন। তেতাল্লিশও দেখায় না। কালো মুখের চামড়ায় যেটুকু ভাজ পড়েছে তাও জরার দাগ মনে হয় না। দুই ঠোঁটের নিঃশব্দ হাসি দুই গালের দিকে ছড়িয়ে ওই ভঁজের মধ্যে পড়ে যেন অদ্ভুত চিকচিক করছে।–তারপর উপচে উঠে চোখের কালো তারার দিকে ধাওয়া করছে। বাতাসে বিশৃঙ্খল হয় বলেই হয়তো চুলের বোঝা টান করে পিছনে এসে গোড়ায় শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। বন্ধনীর নীচে একপিঠ চুল কোমরের নীচ পর্যন্ত তাণ্ডব জুড়ে দিয়েছে। কান দুটো চুলে ঢাকা পড়েনি, ওই হাসি যেন শেষে কানের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
খুব হালকা সুরে বললেন, এ জায়গাটার মাহাত্ম আছে, একদিন রামচন্দ্র রুকেছিলেন এখানে, আজ রামকৃষ্ণ রুকলেন।
রামকৃষ্ণবাবু বলতে পারতেন, রামচন্দ্র সীতা-সন্ধানে এসেছিলেন, রামকৃষ্ণের কোনো হারানো-প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই।
কিছুই বললেন না। চেয়ে আছেন। দেখছেন।
রামেশ্বরের ঘাটে দেখলাম বেশ ধর্মেকর্মে মতি হয়েছে।…একবার ফিরেও তাকালে না।
রামকৃষ্ণবাবু আত্মস্থ করলেন নিজেকে। এ-রকম বিড়ম্বনা ভোগ করার তার অন্তত কোনো কারণ নেই! জবাব দিলেন, কলকাতার শুভা গাঙ্গুলী এখানে মাতাজী হয়ে বসে থাকতে পারেন, এটা কোনো কল্পনার মধ্যে ছিল না—
রমণীর মুখে সেই অদ্ভুত সুন্দর নিঃশব্দ হাসিটা আরো যেন বেশি উপচে পড়ছে।–তাছাড়া চেহারাটাও ফিরে তাকানোর মতো নয়।
কেন যে হঠাৎ আবার বিব্রত বোধ করছেন রামকৃষ্ণবাবু, জানেন না। কোনো একদিন দেখা হলে কৈফিয়ত তো তারই নেবার কথা। ঘরে আর একজনকে আনার পরেও এই এক রমণীকে দীর্ঘদিন ভুলতে পারেন নি। ভুলবেন কি করে, নিরুদ্দেশ হবার পরেও কম করে তিন চার বছর রেডিওতে আর রেকর্ডে তার গান বাজার কামাই নেই। তারপর অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই বিস্মৃত হয়েছেন।
যে লোকটি তাকে মাতাজীর কথা বলে এদিকে নিয়ে এসেছিল, সে অদূরে এসে দাঁড়াল। তাদের মাতাজী সপ্রশ্ন চোখে তাকাতে সে জানান দিল, টাঙ্গাঅলা বাবুজীকে ভাকছে।
স্পষ্ট হিন্দীতে মাতাজী নির্দেশ দিল, আমার নাম করে তাকে বলে দাও অনেকক্ষণ বসতে হবে–বাবু ডবল ভাড়া দেবেন। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলিয়ে তার চোখে চোখ রেখে দেখলেন একটু।–তোমার তাহলে তিন ছেলে আর এক মেয়ে এখন?
ঈষৎ বিস্ময়ে মাথা নাড়লেন রামকৃষ্ণবাবু- তাই।
-না, মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানি না, যে পাণ্ডার মারফত ওদের কল্যাণে পুজো দিলে তার কাছে শুনলাম!…তা একা তীর্থে এলে, স্ত্রীকে নিয়ে এলে না কেন?
–তিনি অনেক বড় তীর্থে চলে গেছেন।
মহিলা থমকালেন একটু।–কতদিন আগে?
–বছর দেড়েক।
শুভ গাঙ্গুলী ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন একটা।ভাগ্যবতী বলতে হবে। …ছেলেমেয়েদের সব বিয়ে-থা হয়ে গেছে?
মাথা নাড়লেন– হয়েছে।
–তারা কেমন?
–ভালো।
-এ বয়সে একলা তোমাকে তীর্থ করতে ছেড়ে দিলে?