না, বাইরের আচরণে কোনদিন কারো ওপর বিরূপ হননি রামকৃষ্ণবাবু। কিন্তু চাপা খেদ বা ক্ষোভ একটু ছিল বইকি। নিজের স্ত্রীর মেজাজপত্র খুব ভালো ছিল না। হয়তো একটু অল্পেতেই রেগে যেতেন। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু ঠিকই অনুভব করতেন ছেলেরা বা বউমারা তাদের মা বা শাশুড়ীর ওপর তুষ্ট ছিল না খুব। ওদের আচরণে আঘাত পেয়ে স্ত্রীকে অনেক সময় স্তব্ধ দেখেছেন। ছেলেদের অথবা ছেলের বউদের কিছু বলতেন না, স্ত্রীকেই বোঝাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু মনের ব্যথা মনেই চাপা থাকত।
শাশুড়ীর পরে কর্তৃত্বের হাত-বদল হয়েছে। ছেলেরা চোখ রাখে তার ওপর, বউমারা যথাসাধ্য সেবা-যত্ন করে, মেয়ে একদিন অন্তর একদিন এসে বাপের খবর নেয়। তবু সে-সবের কোনো তাপ যেন বুকের তলায় স্পর্শ করে না। উল্টে টুকরো টুকরো এক-একটা ব্যাপার মনে পড়লে হাসি পায়। কিন্তু সে-হাসি খুব সুখের নয়। … বাড়িটা তিন ছেলের নামে লেখাপড়া করে দেবার পর মেয়ে-জামাইয়ের মুখ শুকনো-শুকনো মনে হয়েছে। বাড়িটার দাম ধরে তার তিন ভাগের এক ভাগ নগদ টাকা মেয়ে-জামাইয়ের নামে চালান করার সময় আবার ছেলেদের বা বউমাদের মুখে তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি।
..গল্প উপন্যাস মিলে কম করে দেড়শ বই আছে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর; এই সাতান্ন বছর বয়সেও সম্পাদক আর প্রকাশকদের তাগিদের জ্বালায় অস্থির হতে হয়। সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকরা এখনো বাড়িতে হানা দেয়। তার লেখা বহু উপন্যাস গল্প এযাবত ছবি হয়ে গেছে–আরো অনেক হতে পারে। এ ছাড়াও ওই দেড়শ গল্প-উপন্যাসের বইগুলো বেশির ভাগই সচল এখনো। মাস গেলে মোটা রয়েলটি আসে। এই সব বই কিভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে ছেলেদের আর মেয়ের মনে সেজন্যে একটু প্রচ্ছন্ন উদ্বেগ আছে মনে হয়। ছেলেরা একবার হালকা কথাবার্তার ফাঁকে এই প্রসঙ্গ উত্থাপনও করেছিল।
হঠাৎ সচকিত রামকৃষ্ণবাবু, পুরোহিতের মন্ত্র পড়ানো কখন শেষ হয়েছে কে জানে–বাবুকে ভাব-তন্ময় মনে করে পুরোহিত আর তার চেলা নির্বাক।
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। চাতাল অনেকটা ফাঁকা এখন। কোণের দিকের মাতাজীর সামনে মাত্র পাঁচ-সাতটি মেয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে এখন। বাতাসে তার লালপাড় শাড়ির আঁচল উড়ছে। একটু উঁকি দিলেই রামকৃষ্ণবাবু মাতাজীর মুখ দেখতে পেতেন, কিন্তু সে-রকম কোন আগ্রহ হলো না।
চেলা মন্দিরের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দক্ষিণভারতে বহু মন্দির কল্পনাতীত স্থপতিমাহাত্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে। রামেশ্বরের মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয়। এর করিডরটিই শুনেছি চার হাজার ফুট।
পুরী বারাণসী গয়াধাম ইত্যাদি দ্বাদশ কূপের চব্বিশ বালতি মিঠে জল তার মাথায় ঢাললো পাণ্ডার চেলা। স্বচ্ছ জল, ভালো লাগল। তারপর সেই ভিজে জামা-কাপড়ে চল্লিশ মিনিট লাইনে দাঁড়ানোর পর দর্শন এবং পূজো শেষ।
গায়ে ভিজে জামা-পাজামা, খালি পা, বাইরে মাটি তেতে আছে, মাথার ওপর সূর্য জ্বলছে। এবারে একটু ক্লান্ত বোধ করছেন রামকৃষ্ণবাবু। চেলার সঙ্গে চাতালে এসে উঠলেন আবার–সেখানেই শুকনো জামা-কাপড়। কোণের মাতাজীর সামনে জনাতিনেক লোক তখন। রমণী এদিকেই চেয়ে আছেন–সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে রামকৃষ্ণবাবু আড়চোখে তাকালেন একবার–কালোকুলো মুখের একপাশ দেখতে পেলেন। রমণী তার দিকেই চেয়ে আছেন মনে হল, কিন্তু রামকৃষ্ণবাবুর তখন ঘরে ফেরার তাড়া। সোজা চাতালের আড়ালে চলে গেলেন। জামা-পাজামা বদলে ভিজেগুলো হাতে তুলে নেবার আগে একজন স্থানীয় লোক এসে চেলাটির কানে কানে কি বলতেই। সে ব্যস্তসমস্ত মুখে চলে গেল।
রামকৃষ্ণবাবু সোজা চাতাল থেকে নেমে এলেন। চেলার প্রাপ্য সে আগেই পেয়েছে। মাতাজীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সে কথা বলছে। মাথায় কাপড় তোলা মাতাজীর কালো মুখের একটু আভাস মাত্র পেয়েছেন। তা দক্ষিণভারতে রূপসী রমণীর দর্শনলাভ একটা বিরল, ব্যাপার।
বিকেলে আবার বেড়াবার জন্য রাস্তায় নামলেন। পায়ে পায়ে টাঙ্গা আর টমটম ঘেঁকে ধরছে–এখানকার যাত্রীদের পাঁচ পা হাঁটতে দেখলেও ওরা বরদাস্ত করতে চায় না। সমুদ্র বা মন্দিরের দিকে এগোতে মালা-অলা আর শাক-অলারাও সঙ্গ নিতে ছাড়ে না।
–রামঝরুক্কা–বাবুজী রামঝরুক্কা চলিয়ে!
কম করে দশটা টাঙ্গাঅলার মুখে এই একই হাঁকডাক শুনলেন রামকৃষ্ণবাবু। রামঝরুক্কা কি ব্যাপার বোধগম্য হল না।
এক ছোকরা টাঙ্গাঅলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, রামঝরুক্কা কেয়া হ্যায়?
সাগ্রহে টাঙ্গা থেকে নেমে এসে ও বলল, রামজীকো চরণ দর্শন হোগা, নসিব হো তো মাতাজী কো গানা ভি শুনিয়েগা–আই-এ সাব, বৈঠিয়ে।
উঠে বসেই পড়লেন।
দুদিকের তেঁতুল-সারির মাঝখান দিয়ে সুন্দর পাকা রাস্তা। মাইল তিনেক বাদে। রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের সামনে এসে থেমেছে। সামনে একতলা সমান প্রশস্ত বাঁধানো চাতাল, তার ও-পাশে একতলার মতো সিঁড়ি ভাঙলে মন্দির।
চাতালের সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো। সেটা পড়ে হাসিই পেয়ে গেল। জায়গা বা মন্দিরের নাম হল রামজী রুককা। অর্থাৎ সীতা অন্বেষণের পথে রামজী এখানে থেমেছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের অপর প্রান্তে স্বর্ণলঙ্কার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন।
মন্দিরে উঠলেন। চারদিকে রেলিং-ঘেরা বাঁধানো চাতালের মাঝখানে ছোট মন্দির। সেখানে রামজীর পাষাণ-চরণচিহ্ন। সেই দর্শন সারতে এক মিনিটও লাগে না। চাতালের চারদিকে ঘুরে সমুদ্র দেখাটা সত্যিই লোভনীয়। সেই উদ্দেশ্যে সবে দরজা দিয়ে। বেরিয়েছেন–সেখানকার একজন লোক তার কাছে এসে সবিনয়ে জানালো, মাতাজী বোলাতে।