..মাদ্রাজে পৌঁছে তিনি টেলিগ্রামে পৌঁছানো-সংবাদ এবং কুশল সংবাদ দিয়েছেন। তারপর সাতদিনের মধ্যে অনির্দিষ্ট পর্যটনে বেরিয়ে পড়ার আগে তাদের চিঠি লিখে জানিয়েছেন, এত ভালো আছি যে এক জায়গায় আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বেরিয়ে পড়ছি, কখন কোথায় থাকব এরপর ঠিক নেই, নিয়মিত চিঠিপত্র না পেলে একটুও চিন্তা কোরো না।
…দেখলে কেউ বলবে না রামকৃষ্ণবাবুর বয়েস এখন সাতান্ন। শরীর শক্ত মজবুত এখনো। চুলের তলায় তলায় কিছুটা পাক ধরেছে, একটা দাঁত নড়েনি বা পড়েনি। এখন তার পোশাক ঢোলা পাজামা আর ঢোলা রঙিন পাঞ্জাবি। এই পোশাকে বয়েস আরো কম দেখায়। এভাবে বেরিয়ে পড়ার পর রামকৃষ্ণবাবু যেন একটা ভারী মহার্ঘ্য জিনিস ফিরে পেয়েছেন। সেটা তাঁর যৌবন আর যৌবনস্মৃতি। শক্তসমর্থ লোকের মতোই ঘোরাফেরা করছেন–কারো মুখাপেক্ষী নন, সম্পূর্ণ নিজের ওপর নির্ভরশীল। …দীর্ঘদিন ধরে এই আত্মপ্রত্যয়টুকুই তিনি খুইয়ে চলেছিলেন। ছেলেমেয়ে বউমা নাতি নাতনী পরিবৃত হয়ে তিনি যেন অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছিলেন। বেশ একটা খোশমেজাজের জরা নেমে আসছিল তার ভিতরে বাইরে।
..প্রত্যয়ের এই নতুন স্বাদে ভরপুর হয়ে স্ত্রীর কথাও চিন্তা করেছেন বইকি। আজ পাশে সে শুধু সে থাকলে বেশ হত। স্ত্রীর বেড়াবার ঝোঁকও ছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু তখন সাফল্যের ভরা জোয়ারে ভাসছেন, এই জোয়ার থেকে কেউ তটে এসে বিরাম চায় না।
গাড়ি ফাঁকা। যাত্রীরা সব নেমে গেছে।
রামকৃষ্ণবাবু উঠলেন। কুলীর মাথায় হোলড়-অল আর ছোট সুটকেস তুলে দিয়ে প্রথমে রেলওয়ের রিটায়ারিং রুমের সন্ধানে এলেন।
সিঙ্গল রুম ভাড়া হয়ে গেছে, ডাবল রুমের ভাড়া বেশি–সেটা খালি আছে। রামকৃষ্ণবাবু সেটা বুক করে মালপত্র রেখে নিশ্চিন্ত।
রামেশ্বরে এসে সমুদ্রস্নান না করলে আসাটাই অসমাপ্ত। পুণ্যের লোভ না থাকলেও সমুদ্রস্নানের ইচ্ছে আছে রামকৃষ্ণবাবুর। মুখ-হাত ধোওয়া চা-খাওয়া ইত্যাদির পর গামছা আর নতুন একপ্রস্থ পাজামা পাঞ্জাবি কাঁধে ফেলে বেরিয়ে এলেন। রামেশ্বরের মন্দির এবং স্নানের জায়গা কাছাকাছি। স্নান সেরে মন্দিরে পূজো দেওয়ার বিধি।
টমটমে করে স্নানের বাঁধানো চাতালের সামনে নামলেন। স্টেশন থেকে তিন। কোয়ার্টার মাইল পথ হবে–রোদ চড়া তখন।
এ-সময় সমস্ত মানুষেরই গন্তব্যস্থান ওই একটি। টমটম থেকে নামতেই দুজন পাণ্ডার চেলা দুদিক থেকে এগিয়ে এলো। এদিকের পাণ্ডার সঙ্গে তাদের তফাৎ হল তারা বিনীত বেশ। রামকৃষ্ণবাবু মাথা নাড়লেন, পাণ্ডার দরকার নেই। একটু চেষ্টা করে একজন সরে গেল, আর একজন ছোকরা কিন্তু লেগেই থাকল। সে আবার জামা জুতো রাখার ভার নেবে, পূজোর সব ব্যবস্থা এবং দর্শনাদি করিয়ে দেবে, এমন কি আজকের বিশেষ পূণ্যদিনে ওই যে মাতাজী এসেছেন রামঝরক্কা থেকে, তারও দর্শনলাভের এবং আশীর্বাদলাভের ব্যবস্থা করে দেবে।
সমুদ্রের ডানদিক ঘেঁষা উঁচু বিশাল বাঁধানো চাতালের একদিকে হাততুলে দেখালো সে। সেখানে দস্তুরমতো মেয়ে-পুরুষের ভিড়। অর্থাৎ মাতাজীর দর্শন এবং আশীর্বাদ। লাভ করছে তারা।
রামকৃষ্ণবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ কিছুরই দরকার নেই। কিন্তু লোকটা নাছোড়। সবিনয়ে বলতে লাগল, দেবস্থানম-এ এসেও ছেলেমেয়ের কল্যাণের জন্য পূজো দেবে না এ কেমন কথা বাবুজী– ভগবানের কাছে ডালি দাও, ছেলেপুলের ভালো হবে।
এইবার রামকৃষ্ণবাবু থমকালেন। ছেলেমেয়ের কল্যাণ তিনি চান, মঙ্গল চান। পূজো দিলে কতটুকু কল্যাণ বা মঙ্গল হবে জানেন না, কিন্তু না দিলে ক্ষতি হবে কিনা কে জানে। আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাননি, কোথায় কি আছে, কোন জায়গার কি স্থানমাহাত্ম কে জানে?…কাতারে কাতারে লোক সমুদ্রে স্নান করছে, সকলেই তারপর পূজো দেবে। কিছুই যখন জানেন না কি হয়, আত্মাভিমান নিয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার দরকার কি? তাছাড়া এখানে কে চিনছে, কে জানছে তাঁকে? পরে ছেলেমেয়েদেরও জানার দরকার নেই…এই আত্মপ্রসাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার দরকার কি?
চেলার হাতে জামাকাপড় জিম্মা করে কোমরে গামছা জড়িয়ে তিনি সমুদ্রে নামলেন। তার আগে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলেন, পাণ্ডার চেলা তরতর করে ওই বাঁধানো উঁচু চাতালে উঠে গেল। মন্ত্র-মোক্ষদাতারা সব ওখানেই বসে।
অনেকক্ষণ ধরে চান সেরে উঠে এলেন। নুন-জলে গা চটচট করছে। ঘরে ফিরে আবার একদফা চান করতে হবে। কিন্তু খুব তাজা লাগছে এখন, আর বয়েসটা যেন আরো কম ঠেকছে নিজেরই।
ডালি হাতে পাণ্ডা চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে। ভিজে জামাকাপড় বদলানোর নামে সে ঘনঘন মাথা নাড়লে। সিক্তবস্ত্রে পূজো দেওয়ার বিধি। বলল, চাতালের ওই পুরোহিতের কাছে মন্ত্রপাঠ শেষ করে মন্দিরে যেতে হবে। তারপর দ্বাদশ কুণ্ডর মিঠে জলে স্নান করে দর্শন ও পূজো শেষ করতে হবে।
মিঠে জলের স্নান ছাড়াও নিজের সহিষ্ণুতা যাচাইয়ের ইচ্ছেও হল। নেমে গেছেন। যখন রামকৃষ্ণবাবু–সব ঠিক আছে।
এগারোটি টাকা আগে গুনে দিয়ে পুরোহিতের সামনে আসনে বসলেন। পুরোহিত জিজ্ঞাসা করলেন, কার কল্যাণে পূজো?
একটু ভেবে রামকৃষ্ণবাবু তিন ছেলে আর মেয়ের নাম করলেন। মনে মনে তাদের সুমতি প্রার্থনা করলেন। পুরোহিতের সঙ্গে মন্ত্র আওড়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই বিমনা হয়ে পড়লেন। ছেলেদের, মেয়ের, বউমাদের একে একে সকলের মুখগুলো চোখে ভাসল রামকৃষ্ণবাবুর–আর কিছু না চেয়ে শুধু সুমতি চাইলেন কেন?