আমাদের আহার সমাধা হল। মজুমদার মশাই আর হিরু গুপ্ত ঢকঢক করে জল খেয়ে পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। এখন একটু জোর পাওয়ার ফলে হিরু গুপ্তর সঙ্গে এবারে মজুমদার মশাইও কেবিনের বাইরে গেলেন।
আমি মজুমদার মশাইয়ের সচিত্র ফিল্ম ম্যাগাজিনটা ওল্টাতে লাগলাম।
একটু বাদেই মিলু মজুমদারকে একটু যেন সচকিত দেখলাম। মুখ না তুলেও মনে হল বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু বলবে কিনা ভেবে পেলাম না। কৃত্রিম মনোযোগে চোখ দুটো জার্নালের দিকে আটকে রেখেছি।
নিঃশব্দে একবার উঠে কেবিনের দরজা দিয়ে দুদিকের করিডোর দেখে নিল মিলু। তারপর আবার এসে বসল। আমার পড়ার মনোযোগ লক্ষ্য করল। তারপর নিজের খাবারের ডিশটা আঁচলের আড়ালে নিয়ে তেমনি নিঃশব্দে কেবিন ছেড়ে বেরুল।
জার্নাল ফেলে আমি কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালাম।
দেখলাম ডিশ হাতে মিলু দ্রুত ডানদিকের খোলা দরজার সামনে গেল। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছি। মিনিট দুই-তিনের মধ্যেই নীচের দুতিনটে অল্পবয়সী গ্রাম্য ছেলে এসে দাঁড়াতে ওদের ডেকে ডিশের সব খাবার ঢেলে দিয়েই মিলু তাড়াতাড়ি ফিরতে গেল।
-আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
চকিতে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে দত্তপায়ে কেবিনে ঢুকে গেল সে। আমিও এলাম।
অপ্রতিভ মুখখানা আবার লালছে দেখাচ্ছে একটু।
জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার সব এভাবে দিয়ে দিলেন যে?
বিব্রত সুরে জবাব দিল, রাম নাম করে যেভাবে শব সাজিয়ে ওগুলো নিয়ে এসেছে… মনে হচ্ছিল ওতে শবের ছোঁয়া লেগে গেছে… ইয়ে আমার বড় খারাপ অভ্যেস–তারপরেই অনুনয়ের সুরে বলল, ওই শয়তানটাকে আপনি যেন কিছু বলবেন না, আমাকে তাহলে খেয়ে ফেলবে
শয়তান অর্থাৎ হিরু গুপ্ত। চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে আছি। সংযমের এক অনির্বচনীয় কমনীয় মূর্তি দেখছি যেন। গতরাতের বিতৃষ্ণ অনুভূতিটা দ্রুত নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।
মাথা নাড়লাম– বলব না। নিঃসংশয়ে অনুভব করছি, এই মেয়েকে শুচিতার গণ্ডি থেকে বার করবে এমন সাধ্য হিরু গুপ্তর নেই।
ফেরারী অতীত
তখনো ভালো করে ফর্সা হয়নি, বিশ হাত দূরে চোখ চলে না। কামরার মধ্যে বেশ একটা গুঞ্জন উঠতে রামকৃষ্ণবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। সামনে পাশে পিছনে ফটাফট জানলা খোলার শব্দ।
পামবান ব্রিজ আসছে। গাড়ির গতি কমেছে। ওই ব্রিজ পার হলে খানিকক্ষণের মধ্যে রামেশ্বরম–সাদা বাংলায় রামেশ্বর। যাত্রীদের এই ব্রিজ সম্পর্কে একটু বাড়তি আগ্রহের কারণ আছে। এই সেতু পেরুলে মহামোক্ষ ক্ষেত্র। সেতুর এধারে বন্ধন ওধারে মুক্তি। ওই সেতু উত্তরণের আগে পার্থিব জগতের যা-কিছু সব ওধারেই ফেলে এসো।
কজন সত্যিই তাই আসে রামকৃষ্ণবাবু জানেন না। তবু নির্লিপ্ত মুখে তিনিও সামনের জানলাটা খুললেন। ট্রেন ব্রিজে উঠলেই অন্যরকম শব্দ। এদিকের সবই ছোট লাইনের ছোট ট্রেন। তা সত্ত্বেও ব্রিজে ওঠার আগে থেকেই গাড়িটার শম্বুকগতি একেবারে। এটা কোনো নিরাপত্তার কারণে কি যাত্রীদের সুবিধার্থে রামকৃষ্ণবাবু জানেন না।
আবছা অন্ধকার ভেদ করা একটা একাগ্রতা নিয়ে দেখতে লাগলেন তিনিও। শতসহস্র সেতুর মতোই একটা। তবে নীচে নদীর বদলে সমুদ্র–সমুদ্রের ফালিও বলা যেতে পারে। সেতুটা বিশাল বটে, অনেকক্ষণ লাগল পার হতে। কামরার মধ্যে মেয়ে পুরুষদের সমুদ্রে পয়সা ফেলার হিড়িক পড়ে আছে। লোভ কাম মোহ মাৎসর্যের প্রতীক দুনিয়া তিননয়া পাঁচনয়া দশনয়া সিকি আধুলি বিসর্জন দিয়ে মুক্ত মন নিয়ে মহাধামে পদার্পণের প্রেরণা কিনা এটা রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী জানেন না। একটি মহিলার তার দেড় বছরের শিশুকে দিয়েও সমুদ্রে পয়সা ফেলার উদ্দীপনা লক্ষ্য করে নিজের মনেই হেসেছেন।
রামেশ্বরে গাড়ি থামল যখন, চারদিক বেশ পরিষ্কার। যাত্রীদের নামার তাড়ায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রামকৃষ্ণবাবু অপেক্ষা করলেন খানিক। তাঁর কোন তাড়া নেই। তিনি তীর্থ করতে আসেননি। কোনো মানত নিয়েও আসেননি। এখানে এক দিন থাকবেন। কি তিন দিন নিজেও জানেন না। ভালো লাগলে দুতিন দিন কাটাবেন, না লাগলে আবার বেরিয়ে পড়বেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভালই লাগছে তাঁর। জীবনের এই প্রৌঢ় প্রহরে থার্ড ক্লাস কামরার সর্বসাধারণের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরে বেশ একটা বৈচিত্র্যের স্বাদ উপভোগ করছেন। এদের কেউ তাকে চেনে না, কেউ জানে না, কেউ ঈর্ষা করে না, কেউ তোষামোদ করতেও আসে না। নামের মোহ, নামের। যশখ্যাতি, প্রতিপত্তির শেকল থেকে একটা মুক্তির স্বাদ যে এভাবে অনুভব করা যায়। –রামকৃষ্ণবাবু দীর্ঘদিনের আরাম-ঘরে বন্দী থেকে সেটা যেন ভুলতেই বসেছিলেন। …বাড়ির গাড়িতে মেয়ে আর ছোট ছেলে সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে এসে মাদ্রাজ মেলের ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ কামরায় তুলে দিয়ে গেছল। বড় আর সেজ ছেলে খুঁতখুঁত করছিল।–এয়ার কনডিশনে গেলেই ভালো হত। তিন বউমা রেশারেশি করে যাত্রার সুব্যবস্থায় উঠে-পড়ে লেগেছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণবাবু শেষ পর্যন্ত একটা হোলড অল আর ছোট সুটকেস ভিন্ন আর কিছুই নিতে রাজি হলেন না দেখে তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছে। শ্বশুরের একটু বিবাগী মনোভাব লক্ষ্য করে ভিতরে ভিতরে যেন উতলা হয়েছে তারা। ফার্স্ট ক্লাস থেকে বেরিয়ে থার্ড ক্লাস কামরায় এ-ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি, জানলে তাদের চোখগুলো কপালে উঠত। মেয়ে বার-বার করে বলে দিয়েছে, দুদিন পরে পরে একখানা করে চিঠি দেবে বাবা, নইলে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় থাকব। বড় বউমা বলেছিল, ঠিকঠিক খবর না পেলে কিন্তু আপনার ছেলে কাজকর্ম ফেলে মাদ্রাজ ছুটবে। তখন অন্য বউমাদের দিকে চেয়ে রামকৃষ্ণবাবুর মনে হয়েছে- এ-রকম কথা ওদেরও বলার ইচ্ছে ছিল।