–বি, এ-তে অঙ্ক ছিল, আমার কাছ থেকে অঙ্ক বুঝে নিত।
লতা অধিকারী দেখছেন। দেখছেন দেখছেন দেখছেন।-প্লেন কটায় ছেড়েছে?
রাত সাড়ে আটটায়।
–তুমি সাড়ে চারটেয় বেরিয়েছিলে কেন?
–কিছু, মানে–কেনাকাটা ছিল
আর কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই। শেষবারের মত ওই মুখ ঝলসে দিয়ে লতা অধিকারী বেরিয়ে এলেন। তারপর রাতের মধ্যে আর ওই ঘরমুখো হলেন না। পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় সমস্ত রাত ধরে জ্বললেন আর ছটফট করলেন। ওই শাড়ি কার জন্যে কেনা হয়েছিল, আর ওই ফটোই বা কার-খুব ভালো করেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। জীবনে এরকম স্তম্ভিত আর তিনি হননি। গোবেচারার মুখোশপরা এত শয়তানী তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। পাছে অফিসের কেউ কিছু মনে করে এজন্যে মিসেস অধিকারী বলে চালানো হয়েছে ওই মেয়েটাকে–এতখানি ধূর্ত! অফিসে প্রায়ই যাতায়াত ছিল নিশ্চয়, একদিন দুদিন হলে লোকের চোখে ধূলো দেওয়ার দরকার হত না। জীবনের মতই শিক্ষা দেবেন তিনি, কিন্তু কি যে করবেন ভেবে পাচ্ছেন না বলেই একটুও শান্ত হতে পারছেন না।
…একদিন দুদিন বা একবছর দুবছর নয়–ওই লোক একটানা দশ বছর ধরেই চোখে ধূলো দিয়ে এসেছে তার। নিজের বোকামিটাই থেকে থেকে বড় হয়ে উঠছে! সত্যি সত্যি গোবেচারা হলে আই, এস-সি থেকে এম, এ, পর্যন্ত একটানা ফার্স্ট হয় কি করে, এটা তার ভাবা উচিত ছিল। …সেও আবার অঙ্কে! নির্বোধ হলে তার অত বুদ্ধিমান বাবা তাকে জামাই করতেন না, এ সত্য আজ নতুন করে চিন্তা করতে হল। আর মগজের। সে-রকম জোর না থাকলে দেখতে দেখতে ব্যবসা এত বড় হয়ে উঠত না, তাও এই রাতেই প্রথম উপলব্ধি করলেন। শুধু তাই নয়, অক্সফোর্ডের এম, এ, পাস মেয়ের অত খাতির পেতে হলে মাথায় যে বেশ কিছু থাকা দরকার, তাও হাড়ে হাড়ে অনুভব করছেন তিনি।
মাথার মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে।…এই বাড়ি তার, ওই ব্যবসায়ও তারই। বাবার টাকায়। অনেক কিছুই করতে পারেন তিনি। কিন্তু সেভাবে হেস্তনেস্ত করার। মত আর আক্রোশ মেটার মত কিছুই ভেবে উঠতে পারছেন না।
দিন কাটতে লাগল। একটা দুটো করে মাসও।
লতা অধিকারীর ক্লাবে যাওয়া কমে এলো, ফাংশনে যাওয়া কমে এলো, পার্টিতে যাওয়া কমে এলো, কমতে কমতে বন্ধই হয়ে এলো একসময়। উষ্ণ আপ্যায়নের অভাবে চটকদার পুরুষ-রমণীদের আনাগোনায় ভাটা পড়ল। প্রসাধনের একাগ্রতায় ছেদ পড়ল, ম্যাচিংএ অভিনবত্ব রচনার ঝোঁক গেল, টেপ ব্লাউস গলা থেকে সরতে সরতে ক্রমে কাধ। ঢেকে দিতে লাগল, গায়ের জামা আর শাড়ির মাঝের ফারাক সঙ্কীর্ণতর হতে থাকল।
সমস্ত অবকাশ শুধু একজনের প্রতি সজাগ লক্ষ্য আর প্রহরায় নিবিষ্ট হল।
.
লতা অধিকারী প্রথম সন্তানের জননী হলেন বত্রিশ বছর বয়সে–ছেলে। দ্বিতীয় সন্তান এলো সাড়ে তেত্রিশে–ছেলে। তৃতীয় সন্তান এলো ছত্রিশে–ছেলে।
লতা অধিকারী অসহিষ্ণু বিরতি ঘোষণা করলেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতে আর একজনের অভিলাষ টের পেয়ে তপ্ত হয়ে উঠলেন–একটি মেয়ের বাসনা। সরোষে। একটানা বছর দুই বাসনা নাকচ করে চললেন।
তারপর চতুর্থবার এবং শেষবার নার্সিংহোমে এলেন উনচল্লিশ বছর বয়সে।
এবারও ছেলে।
পরদিন গৌরকিশোর নার্সিংহোমের ঘরে এসে দাঁড়ালেন মাত্র, তার মুখের ওপর এক পলক আগুন ছড়িয়ে লতা অধিকারী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, হয়েছে? ফের কাছে। ঘেঁষবে তো তোমাকে আমি
কি করবেন সেটা আর সম্পূর্ণ করে উঠতে পারলেন না। সেই চিরাচরিত গোবেচারা-মূর্তি দেখে গা জুলল তার। সরোষে পাশ ফিরলেন।
লতা অধিকারীর আটান্ন আর গৌরকিশোরের তেষট্টি।
এ পর্যন্ত সমান দাপটে স্বামী শাসন করে এসেছেন লতা অধিকারী, ওই মুখের সদা গোবেচারা ভাব আজও তার চক্ষুশূল। শাসন দেখে মনে মনে ছেলেরাও মায়ের থেকে বাপের প্রতি বেশি সদয়।
বাইরে তারা আদর্শ অভিজাত দম্পতি। কোনো সভা বা অনুষ্ঠানে একজনকে ছেড়ে আর একজনকে দেখেনি কেউ। অল্পবয়সী ছেলেরা বলে কায়াযুক্ত ছায়া যথা
সেদিনও কি এক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে গেছলেন গৌরকিশোর। লতা অধিকারী যথারীতি তার পাশে প্রধানা মহিলার আসন গ্রহণ করেছেন। সভাপতির চিরাচরিত সংক্ষিপ্ততম ভাষণের ভূমিকা শুনে লতা অধিকারীর গা জ্বলেছে। গৌরকিশোর বলেছেন, বক্তৃতা করার মত অত চালাকচতুর বা চৌকস নন তিনি, অতএব কি আর বলবেন…।
বাড়ি ফিরেই বিব্রত মুখ করে স্ত্রীকে জানালেন, শরীরটা কেমন যেন করছে, ভালো লাগছে না।
বক্তৃতায় টিকা-টিপ্পনী কেটে এসে এখন একটু সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের ছল কিনা, মুখের দিকে চেয়ে সেটাই আগে বুঝতে চেষ্টা করলেন লতা অধিকারী। কিন্তু খটকা লাগল কেমন।
গৌরকিশোর ঠাণ্ডা জল চেয়ে খেলেন এক গেলাস। শুয়ে পড়লেন। শরীরের সমস্ত রক্তকণাগুলো যেন জ্বলছে আর গায়ে আলপিন ফোঁটাচ্ছে। বুকের একদিকে যন্ত্রণাও বোধ করছেন। মাথার উপর পুরোদমে পাখা ঘুরছে কিন্তু তিনি ঘামছেন। চোখে ঝাপসা দেখছেন। স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যেতে দেখলেন। একটু বাদে ফিরে এসে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছেন তাও টের পেলেন। ছেলেরা ঘরে ঢুকেছে, দুজন আবার ছুটে বেরিয়েও গেল মনে হল। চোখ টান করে স্ত্রীর মুখখানাই দেখতে চেষ্টা করলেন তিনি। মাথার ভিতরে সবকিছু গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে, রক্তের জ্বালা বাড়ছে, আর ফাঁকে ফাঁকে কি যেন মনে করতে চেষ্টা করছেন তিনি। ভবিষ্যৎ গণনায় পটু এক বন্ধুকে কবে যেন কি দেখতে পাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন…