সময়মত সুমিতার বাড়িতে, গাড়ি গেল, আর সময় ধরেই সুমিতা এলেন।
সকলে ধরে নিলেন তেমন বিশিষ্ট মহিলাই কেউ এসেছেন, নইলে বড় সাহেব নিজে বেরিয়ে এসে আদর করে তাকে নিয়ে যেতেন না।
ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে চারটেতেই সুমিতাকে নিয়ে হাসিমুখে ঘর থেকে বেরুলেন গৌরকিশোর। দুপা এগিয়েই কি বুঝি মনে পড়ল তাঁর। বললেন, এক মিনিট
আবার ঘরে ঢুকলেন। টেলিফোন তুলে মৃদু গলায় অফিসের অপারেটর গার্লকে নির্দেশ দিলেন কিছু। তারপর রিসিভার রেখে বেরিয়ে এলেন।
.
ঠিক পাঁচটা বাজতে লতা অধিকারীর মুখ গম্ভীর। দাদারা মিনিট তিনেক আগে এসে গেছেন, কিন্তু এই লোকের দেখা নেই। পাঁচটা বেজে পাঁচ হতেই ব্ৰিক্তির তাপ বাড়ল। পাঁচ মিনিট পর্যন্তই তিনি সময়ের হেরফের সহ্য করে থাকেন। গনগনে মুখে দাদাদের কাছ থেকে উঠে এসে শোবার ঘরে ঢুকে টেলিফোন তুলে নিলেন। অফিসের নম্বর ডায়েল করতে অপারেটর মেয়ের সাড়া পেলেন।
–মিঃ অধিকারী প্লীজ!
নির্দেশমতই অপারেটর সবিনয়ে জানালো, তিনি তো নেই, মিসেস অধিকারী এসেছিলেন–একটা জরুরী কাজে তার সঙ্গে তাকে বেরুতে হয়েছে।
স্পষ্ট শুনেও লতা অধিকারী ঠিক বুঝলেন না। বিস্মিত এবং দ্বিগুণ বিরক্ত। –কে এসেছিলেন?
-মিসেস অধিকারী।
লতা বিমূঢ়।–মিসেস অধিকারী কোথায় এসেছিলেন?
–আজ্ঞে, অফিসে।
–মিঃ অধিকারী তার সঙ্গে বেরিয়েছেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি কে কল করছেন বলুন, মিঃ অধিকারী কাল এলে জানাব—
–মিসেস অধিকারী।
রিসিভার আছড়ে রাখলেন তিনি। ওদিক থেকে টেলিফোনের মেয়েটা হতভম্ব।
সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ লতা অধিকারীর। মাথার মধ্যে কি যেন ওলট-পালট হতে শুরু করেছে। বুদ্ধিও ঘুলিয়ে যাচ্ছে কেমন। ঘর থেকে বেরুলেন প্রায় দশ মিনিট বাদে। দাদারা জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে, কি হল?
তিনি বললেন, হঠাৎ কি জরুরী কাজে বেরিয়ে যেতে হয়েছে শুনলাম। আজ আর হবে না দাদা, কতক্ষণ অপেক্ষা করবে।
তারাও বিরক্তি চেপেই উঠে গেলেন।
একলা বাড়িতে লতা অধিকারী জ্বলতে থাকলেন। ঠাণ্ডা মাথায় যত বেশি ভাবতে চেষ্টা করছেন, ততো বেশি জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কানে মাথায় বারকয়েক জল দিয়েছেন। ভাবতে চেষ্টা করেছেন, হতেও পারে আর কোনো মিসেস অধিকারী।…হয়ই যদি আর কেউ, সে এমন কে যার জন্যে বাড়ির অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথাও মনে থাকল না…মনে। থাকলে টেলিফোনে জানিয়ে দিল না কেন?
বিকেল গেল, সন্ধ্যা পার হল–এখনো দেখা নেই। হিজিবিজি চিন্তায় ভিতরটা তেতেই উঠছে ক্রমশ।…অত দামের শাড়ি কিনে এনে চুপচাপ বাক্সে রাখা হয়েছিল কার জন্যে?…ওই ফটোই বা কার? যে-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই, সেখানকার ভাইয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে গেছল…ঠিক বিশ্বাস করা যাচ্ছে না কেন এখন? মিসেস অধিকারী এসে মিঃ অধিকারীকে ডেকে নিয়ে গেল…সকলে কোন্ মিসেস অধিকারী ভেবেছে?
.
লতা অধিকারী কেবল বসছেন উঠছেন ঘরে বারান্দায় ঘুরপাক খাচ্ছেন। ভাবতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু অসহ্য রাগে ভাবতে কিছুই পারছেন না।
গৌরকিশোর ফিরলেন রাত্রি প্রায় সাড়ে নটায়। সুমিতার গাড়ি ছাড়ার পর স্টেশন থেকে বেরিয়ে কি ভেবে দমদম চলে গেছলেন তিনি। এরোড্রামে একটানা দুঘণ্টার ওপর বসে থেকে তারপর উঠে চলে এসেছেন।…ড্রাইভারকে জেরা করবে না হয়ত, সেখানে কালচারের প্রশ্ন। আর করেই যদি, ধরা পড়তে আপত্তি নেই। ধরা পড়বার আশাতেই তো এত কিছু।
অন্য দিন লতা চোখ তুলে তাকান না, আজ শুধু তাকিয়েই রইলেন। স্ত্রীর মেজাজ পত্র সুবিধের নয়, জামাকাপড় বদলাবার ফাঁকে গৌরকিশোর শুধু এটুকুই লক্ষ্য করলেন যেন।
মিনিট পাঁচ সাত দুচোখ দিয়ে ওই মুখ ফালাফালা করে ভিতরে দেখতে চেষ্টা করলেন লতা অধিকারী। লোকটার ওই বিড়ম্বনা অভিব্যক্তি কেন যে মেকী মনে হল জানেন না।–এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
-একটু কাজে আটকে পড়েছিলাম।
–দাদাদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে কাজে আটকে পড়লে কেন?
গৌরকিশোরবাবু যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কাই খেলেন হঠাৎ। কিছু মনে পড়েছে–সমস্ত মুখে সেই চকিতবিমূঢ় অভিব্যক্তি। টোক গিললেন, তারপর আমতা আমতা করে বললেন, হঠাৎ বেরিয়ে পড়তে হল…ইয়ে, ঠিক খেয়াল ছিল না। আবার টেক গিললেন।–তু-তুমি অফিসে আমার খোঁজ করেছিলে নাকি?
রমণীর দুই চোখ তার মুখের ওপর আরো যেন কেটে কেটে বসছে। তিনি চোর ধরেননি, গোবেচারা-মুখ একটা ডাকাত ধরেছেন যেন। জবাব দিলেন না, শুধু প্রশ্নই করলেন।-তুমি কোন কাজে আটকে গেছলে?
মিথ্যে বললে ধরা পড়ার সম্ভাবনা, এই ভয়েই যেন সত্যি জবাব দিলেন। এই…একজনকে তুলে দিতে গেছলাম
কাকে তুলে দিতে গেছলে?
–একটি মে-মানে–মহিলাকে।
–কোথায় তুলে দিতে গেছলে?
দমদম এরোড্রামে।
–তার নাম কি?
ঢোক গেলাটা এবারে বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল লতার চোখে।
–রমা।
রমা কি?
–ব্যানার্জী…
দুই চোখে নিঃশব্দে ওই মুখ আর এক প্রস্থ দগ্ধে দিলেন লতা অধিকারী। মিসেস অধিকারী তাহলে কে, জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করলেন না। যা বোঝবার ঠিকই বুঝেছেন, আরো কিছু বোঝা দরকার।
–তিনি কোথায় গেলেন?
–লণ্ডন।
–একা?
-হ্যাঁ, আগেও একবার গেছল, অক্সফোর্ডের এম, এ। সেখানকার ইকনমিক রিসার্চ অর্গানিজেশনে বড় চাকরি নিয়ে গেল, এখানেও এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের বড় অফিসার ছিল।
-তুমি তাকে চিনলে কি করে?