এই জবাবটা কেন যেন খুব সরল ঠেকল না কানে। দোকানে গিয়ে নিজে পছন্দ করে এরকম শাড়ি কিনে নিয়ে আসতে পারে ধারণা ছিল না।–দামী শাড়ি মনে হচ্ছে, কে বন্ধু? কবে বিয়ে?
নাম করে দিলেন একজনের। বললেন, খুব পুরনো বন্ধু। আজই বিয়ে–মানে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ।
-তোমার একার নেমন্তন্ন?
–হ্যাঁ, তুমি যেতে পারবে না বলে দিয়েছিলাম।
–পারি বা না পারি তোমার বলার কি দরকার ছিল? আর শাড়ি কিনেছ, আমাকে দেখাওনি কেন?
বিপদগ্রস্তের মত শেভিংএ মন দিলেন গৌরকিশোর।
ব্যাপার কিছুই নয়, তবু ভিতরটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল লতা অধিকারীর। তাকে না জানিয়ে বন্ধুর ভাবী বউয়ের জন্য আড়াইশ তিনশ টাকা দিয়ে শাড়ি কেনা হয়েছে, হলে হতেও পারে!
গৌরকিশোর তার অলক্ষ্যে শাড়ি আর ফটো বার করে নিয়ে অফিসে চলে গেলেন।
বেলা চারটে নাগাদ অফিস থেকে বেরুলেন। আজও মা আর বোন তাকে দেখে খুশি। ভাইয়েরা বাড়ি নেই। কিছুদিন ধরে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে সকলেরই। বিশেষ করে মায়ের। ছেলে প্রায়ই আসছে, তাদের সকলকে নিয়ে সেদিন গাড়ি করে দক্ষিণেশ্বর থেকে বেড়িয়ে এনেছে–সুমিতা এসেছিল, তাকেও জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। আনন্দে মায়ের চোখে জল এসেছিল। হৈ-চৈ আনন্দের মধ্যে কেটেছে–ছেলে সকলের একসঙ্গে আর আলদা আলাদা সক্কলের ফটো তুলেছে।
সেদিনও গৌরকিশোর হাসি-খুশি। শাড়ির প্যাকেট বোনের হাতে দিলেন, নে, এটা তুই পরিস।
শাড়ি দেখে বোনের, আর সেই সঙ্গে মায়েরও চোখ ঠিকরোবার উপক্রম। এ রকম দামী বেনারসী পরা দূরে থাক, বোন হাতে নিয়েও দেখেনি।–এ তুমি আমার জন্যে কিনে আনলে নাকি দাদা!
নির্লিপ্ত মুখে গৌরকিশোর বললেন, কিনে না তো কি আমি বেনারসী বানাচ্ছি!
মা বলেছেন, যত্ন করে তুলে রেখে দে, পরে কাজে লাগবে।
বোন মুখ লাল করে উঠে গেছে। পরে গৌরকিশোর তার মুখেই শুনেছেন, সুমিতাদি আগামী পরশু দিল্লী চলল, সেখানে কি একটা ভালো চাকরি পেয়েছে।
গৌরকিশোরকে অন্যমনস্ক দেখা গেল একটু। ঠিক এরকম খবর আশা করেননি। খানিক বাদে আবার গাড়িতে উঠলেন। তখনো চিন্তামগ্ন।
গাড়ি সুমিতাদের বাড়ির দরজায় থামল। সুমিতা তাকে দেখে অবাক প্রথম, পরে খুশি। আদরযত্ন করে বসালেন, পরে ঠাট্টাও করলেন, এই বাড়িতে ওই গাড়িসুদ্ধ তার মালিক হাজির–কি ব্যাপার?
গৌরকিশোর বললেন, দিল্লীবাসিনী হচ্ছ শুনলাম, তাই এলাম দেখা করতে
। সুমিতা হাসলেন, আমার দিল্লী যাত্রার ভাগ্য বটে!
–কবে যাচ্ছ?
-এই তো পরশু, প্রথমে পাটনায় দিদির কাছে যাব, সেখানে দুদিন থেকে দিল্লী।
–পাটনার গাড়ি কটায়?
–বিকেল পাঁচটা পঁয়ত্রিশে শুনলাম, কেন, সী অফ করতে যাবে?
গৌরকিশোর হাসলেন। কিন্তু তিনি দ্রুততালে চিন্তাও করেছেন কিছু। বললেন, যেতে পারি, বলো তো স্টেশনে পৌঁছেও দিতে পারি।
কি ভাগ্যি! বিশ্বাস করতে বলছ? দিলে তো বেঁচে যাই, আমার সঙ্গে আবার একগাদা মালপত্র।
–ঠিক আছে, আমার গাড়িও ছোট নয়। সাড়ে তিনটেয় গাড়ি তোমার দরজায় হাজির হবে, সোয়া চারটের মধ্যে তুমি আমার অফিসে পৌঁছচ্ছ–পনের মিনিটের মধ্যে তুমি আমার অফিস দেখবে আর এক পেয়ালা চা খাবে–ঠিক সাড়ে চারটেয় আমরা বেরিয়ে পড়ব।
–আবার তোমার অফিসে নামব।
–নিজের হাতে, গড়লাম, একদিন দেখবেও না?
অতএব সুমিতা সানন্দে রাজি হয়েছেন।
এখানেও এক দফা চা খেয়ে গৌরকিশোর ওঠার আগে ব্যাগ খুলে ফটো বার করে তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন।–নাও, তোমার ফটো যখন, এক কপি তোমারও প্রাপ্য।
ফটো পেয়ে সুমিতা আরো খুশি। জিজ্ঞাসা করলেন, অনেক তো তোলা হয়েছিল সেদিন, আর সকলের কই?
-ডেভেলপ করা হয়নি এখনো, পরে পাঠাবখন।
গাড়িতে বসে আবার চিন্তাচ্ছন্ন গৌরকিশোর। বাড়ি ফিরলেন। স্ত্রী বাড়িতে নেই। ভাবনার অনুকূল অবকাশ পেলেন। কিন্তু যা ভাবছেন, তার সুরাহা ঠিক হল না যেন।
পরদিন অফিসেও চিন্তামগ্ন। আগামী কাল ঠিক পাঁচটায় স্ত্রীর সঙ্গে একটা জরুরী সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন সৃষ্টি করা দরকার। ঠিক সেই সময়ে একসঙ্গে দুজনের কোথাও এক পার্টির নেমন্তন্ন থাকলেও বেঁচে যেতেন।
নেই। ফাইল সব টেবিলে পড়ে থাকল, গভীর ভাবনায় গৌরকিশোর তন্ময়।
হঠাৎ সচকিত তিনি। মনে পড়েছে কিছু। ভিতরে চাপা উত্তেজনা। ঠাণ্ডা হয়ে বড় শালাকে টেলিফোন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, সকলে মিলে কেনার জন্য সেদিন একটা জমি দেখার কথা বলছিলেন, সেটা কোথায়?
ওধার থেকে জবাব এলো, তোমার বাড়ি থেকে গাড়িতে মিনিট পনেরর পথ।
–ঠিক আছে, কাল চলুন তাহলে–এর মধ্যে কালই তবু বিকেলের দিকে একটু ফ্রী আছি।
পরদিন বিকেলেই জমি দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা হল। বিকেল পাঁচটা থেকে পাঁচটা দশ মিনিটের মধ্যে দুই শালা তার বাড়িতে আসবেন। গৌরকিশোরও অফিস থেকে তার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছুবেন। তারপর তাকে নিয়ে সকলে মিলে জমি দেখতে যাবেন।
পরদিন দাদাদের সঙ্গে জমি দেখতে যাওয়ার প্রোগ্রাম লতা রাত্রিতে শুনলেন। দাদারা যাতে আছেন তাতে তারও আগ্রহ স্বতঃস্ফুর্ত। অতএব তিনি সানন্দে রাজি।
পরদিন অফিস যাবার আগে তিনিই স্মরণ করিয়ে দিলেন, পাঁচটার একটু আগেই চলে এসো, দেরি কোরো না-তোমার তো আবার যা সময়ের জ্ঞান
অফিসে এসে সেদিন আর ফাইল স্পর্শও করলেন না গৌরকিশোর।