পাঁচ বছরে শাখা-প্রতিষ্ঠান ভালোই দাঁড়িয়েছে। লতার বদ্ধ ধারণা, বাবা চোখ রেখেছিলেন, ছোড়দা আছেন, দরকারমত বড়দা-মেজদাও পরামর্শ দেন, তার ওপর বিশ্বস্ত কর্মচারীরা আছে–তাই দাঁড়িয়েছে। আর কারো কোনো কৃতিত্বের ছিটেফোঁটাও
বিয়ের সাত বছরের মধ্যে নতুন কোম্পানীর লাভের টাকা দিয়ে লতার জমিতে মস্ত বাড়ি উঠেছে। গৃহপ্রবেশে ঘটা করে উৎসব করা হয়েছে।
তারপর কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী চোখ বুজেছেন। স্টিল অ্যাণ্ড নেট অ্যায়ারিং-এর শিকড় তখন। পরিপুষ্ট। উইল-এ দেখা গেল, এই কোম্পানীর মালিকানার সবটাই তিনি ছোট মেয়ে জামাইকে দিয়ে রেখেছেন। অন্যান্য বিষয়-আশয় এবং চ্যাটার্জী মেটালস তিন ভাইয়ের।
অতএব ছোট ছেলে ভগ্নিপুতির ব্যবসায়ের সংস্রব ছেড়ে চ্যাটার্জী মেটালস-এ চলে এসেছেন। লতা বিমর্ষ এবং চিন্তিত হয়েছিলেন। দাদাদের বলেছিলেন, তোমরা চলে এলে ওর দ্বারা ব্যবসা চলবে?
দাদারা আশ্বাস দিয়েছেন–তারা চোখ ঠিকই রাখবেন, তাছাড়া বিশ্বস্ত কর্মচারীরা তো থাকলেনই।
.
লতার ছাব্বিশ, গৌরকিশোরের একত্রিশ।
যার বীজ ভালো তার ফসলও ভালই। দুর্ভাবনা সত্ত্বেও কোম্পানী যে রীতিমত জাঁকিয়ে উঠেছে, তার পিছনে এটাই কারণ ভাবেন মিসেস অধিকারী। গৌরকিশোরই এ ব্যবসার হর্তা-কর্তা বিধাতা বটে, কিন্তু ভাগ্য চারদিক থেকে নিরাপদ প্রহরায় একজন অতি সাধারণ মানুষকে ওইখানে এনে তুলেছে, এই ধারণা তার একটুও বদলায়নি।
ছেলেপুলে এখনো হয়নি। তার কারণ মিসেস অধিকারী এখনো তা চাননি। একতিরিশেও একুশের থেকে বেশি মন দিয়ে সাজ-সজ্জা করেন। সেটা বরং দিন কে-দিন সূক্ষ্মতর হচ্ছে। গায়ের জামা আর শাড়ির মাঝে আড়াই আঙ্গুলের জায়গায়। এখন চার আঙ্গুল কোমর দেখা যায়। কঁধখোলা মিহি ব্লাউসের টেপ ক্রমে গলার দিকে ঘেঁষছে। পোশাক-আশাকের ম্যাচিংএ অভিনবত্ব আসছে। বক্ষদেশের সম্ভারে বিভ্রম ছড়ানোর ললিত প্রয়াস স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। প্রসাধনের পারিপাট্য বেড়েছে। অভিজাত এলাকায় হাই সোসাইটির চটকদার পুরুষ-রমণীর আনাগোনা বেড়েছে।
গৌরকিশোরের অবকাশ কম। প্রচুর খাটেন। আরো খাটলেও আপত্তি নেই লতা অধিকারীর। তাঁর এ-দিকটা নিজস্ব দিক, সংস্কৃতির দিক, মনের পুষ্টির দিক। অতএব গৌরকিশোর মুখ বুজে কাজ করেন আর লতা বা লোটি অধিকারী ঘণ্টা দেড়েক কেশ বিন্যাস করে ক্লাবে যান, ফাংশানে যান, পার্টিতে যান। কিন্তু হাই সোসাইটির রীতি অনুযায়ী যুগল উপস্থিতিরও প্রয়োজন হয় অনেক সময়। স্ত্রীর কাছে তখনই শুধু তাড়া খেতে হয় গৌরকিশোরের। বলেন, তোমাকে নিয়ে বেরুতে হলেই আমার ভাবনা হয়, ঠিক-ঠাক হয়ে নাও। নিজের ঠিক-ঠাক হওয়ার দিকে এই একজনের অবাধ্য দৃষ্টি বার কয়েক ঘুরতে দেখলেও ধমকে ওঠেন, হ্যাংলার মত চেয়ে থেকো না, আর পার্টিতে গিয়ে আমার পিছনে ঘুরো না–নাও চলো।
অথচ অনুষ্ঠানের কোনো সুপুরুষ যখন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন,-ইউ লুক এক্সকুইজিট ম্যাডাম–তার হাতে হাত রেখে স্ত্রীটিকে বিগলিত হতে দেখেন গৌরকিশোর। বলতে শোনেন, থ্যাঙ্ক ইউ
বোকা-বোকা মুখ করে আরো কিছু লক্ষ্য করেন গৌরকিশোর। কারো সঙ্গে শুধু অন্তরঙ্গতা, কারো সঙ্গে বা বেশি। এরই মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলিতে স্ত্রীর সেই বেশি অন্তরঙ্গতার রূপটাও গৌরকিশোরের নির্বাক চোখে বসে গেছে। একা বেরুলে স্ত্রীর অনেকদিনই ফিরতে রাত হয়–এতেও প্রায় অভ্যস্তই হয়ে উঠেছেন তিনি। …
মিসেস লোটি অধিকারীর স্বাভাবিক দিনযাপনের সামান্য একটু অস্বস্তির ছায়া। পড়ল সেদিন হঠাৎ।
নিজের চেকবই দুটো যে কোথায় রেখেছেন খুঁজে পাচ্ছেন না। গৌরকিশোর দাড়ি কামাচ্ছিলেন। স্ত্রী কিছু দরকারী জিনিস পাচ্ছেন না মনে হতে জিজ্ঞাসা করলেন, কি খুঁজছ?
–চেকবই দুটোর একটাও পাচ্ছি না, এক্ষুনি দরকার।
গৌরকিশোর বললেন, সেদিন তোমার টেবিলের ওপর পড়েছিল দেখে কোথায় রাখলাম…ওই আলমারিতে দেখো তো!
দেখলেন নেই।
–তাহলে ও-ঘরে আমার সুটকেসে রেখেছি বোধ হয়…দেখছি।
অপেক্ষা করার সময় নেই মিসেস অধিকারীর। বিরক্ত।–তোমার সবেতে গোলমেলে কাণ্ড, টেবিলের ওপরে ছিল–ডুয়ারে রেখে দিলেই তো হত!
ও-ঘরে গিয়ে নিজেই সুটকেস খুললেন। চেকবই পেলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো যে দুটো জিনিস চোখে পড়ল, তাতেই অবাক তিনি। একটা ফোটো আর নামকরা দোকান থেকে কেনা একটা শৌখিন শাড়ির প্যাকেট।
ফটো একটি মেয়ের। হাসিমুখ, চেহারাও মন্দ নয়। বেশ স্মার্ট। আর প্যাকেটে কম করে তিনশ সাড়ে তিনশ টাকা দামের শাড়ি একটা।
লতা অধিকারী প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন একটু। এ দুটো বস্তু এখানে কেন বোধগম্য হল না। চেকবই পাওয়ার তাড়া ভুলেছেন আপাতত। ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সুটকেসে এক মেয়ের ফটো দেখলাম, কার?
সাবান মাখানো মুখখানায় একটু ব্যস্ততাও লক্ষ্য করলেন যেন।
গৌরকিশোর জবাব দিলেন, আ…আমার ভাইয়ের জন্য, মানে সত্যর জন্য এক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেছলাম…ভদ্রলোক ধরেছিলেন, তারাই দিয়ে দিলেন।
স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যে-ভাবে বললেন স্ত্রীর সেটাই বিরক্তির কারণ। দশ বছরেও যদি কথাবার্তা সপ্রতিভ হত একটু!–আর, শাড়ির প্যাকেট দেখলাম, সেটা কার?
-ইয়ে, এক বন্ধুর বিয়ে, দেব বলে কিনেছি।