আশ্চর্য, অপর্ণা যে তার এতখানি এ কি নিজেই জানতেন! পাশে থাকতে কথা দিয়েছেন যখন, তখনও কি জানতেন? তখনো কি এরকম করে অনুভব করতে পেরেছিলেন?
ক্রস রোডে গাড়ি চলেছে তো চলেছেই। এক মিনিট এত বড় হয় কি করে?
…তবু তুমি কথা দাও, কথা দাও না গো!
কথা যখন দিয়েছিলেন, তখনো কি সেই আকৃতি এমন করে শিরাতে শিরাতে ওঠা-নামা করেছিল তার? তিনি তো তার পরেও লোকের চিকিৎসা নিয়ে সদা ব্যস্ত ছিলেন, এমন দম-আটকানো শূন্যতা তো কখনো অনুভব করেননি?
….চিকিৎসার বাইরে আর সকল দিক অপর্ণা এ-ভাবে ভরাট করে রেখেছিল বলেই অনুভব করেননি। তাই বটে। কোনদিন আর কোনদিকে তাকানোর দরকারই হয়নি তার! দুটো মেয়ের বিয়ে হয়েছে, বড় ছেলেটার বিয়ে হয়েছে, আর একটা ছেলেও আগামী বারে ডাক্তারী পাস করে বেরুবে। এরা সব ছোট থেকে হঠাৎ চোখের ওপর দিয়ে কেমন করে যে বড় হল, যোগ্য হল, তাও যেন ভালো জানেন না মেজর ঘোষ চৌধুরী। সব-দিক এমনিই ভরে রেখেছিল বটে অপর্ণা। তেত্রিশ বছরের এই ভরাট দিকটাই শূন্য হওয়ার দাখিল। তাই সবদিকই শূন্য। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে কষ্ট। চোখে ভয়ানক ঝাপসা দেখছেন।
বিষম চমকে উঠলেন– সবুজ আলো! গ্রীন! ব্লেসেড গ্রীন!
হাওয়ার বেগে গাড়ি ছুটল। আশ-পাশের গাড়িওয়ালারা তাঁর গাড়ির এই গতি পছন্দ করছে না। অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে ভাবছে। হলেই হল। মিলিটারি চাকরিতে কোন পথ দিয়ে কি স্পীডে গাড়ি চালাতে হয়েছে তা কে জানবে কি করে। চকচকে চোখ, কিন্তু ঠোঁটে আবার যেন হাসির আভাস একটু–জানলে অপর্ণা বোধহয় সুস্থ শরীরেই হার্টফেল করত। নির্ভয়ে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে আর দুটো চোখ আর সবগুলো স্নায়ু একত্র করেই অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিচ্ছেন তিনি। গাড়িতে বসলে তার খোঁড়া পা আর খোঁড়া থাকে না–ওনলি ডোন্ট ডিসটার্ব মি: এনিবডি অ্যাণ্ড লেট দেয়ার বি নো রেড লাইট এনি মোর!
.
বাড়ি।
সিঁড়ির গোড়ায় পা রেখেইে নিশ্চল স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। কানে গলানো শিসে ঢুকল এক ঝলক। ঝলকে ঝলকে ঢুকছে। তিনি নিস্পন্দ কাঠ।
দোতলার ওই অনেক গলার আর্তনাদের একটাই অর্থ।…অপর্ণা থাকল না। গেলই।
কয়েক নিমেষের মধ্যে বুঝি বুড়িয়ে গেলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। এত বুড়িয়ে গেলেন যে সিঁড়ির শেষ নেই মনে হচ্ছে। ঝকঝকে দুচোখে মুক্তোর মত দুটো কি। হাঁপ ধরছে। দাঁড়ালেন। কি যেন একটা ভুল হয়ে গেছে।…কি? মাথার ভিতরে এরকম লাগছে কেন? তিনি ডাক্তার, জানতেনই তো অপর্ণা থাকবে না!
পকেটের বোতলটা উবুড় করে নিঃশেষে গলায় ঢাললেন।
দোতলা। অপর্ণা শুয়ে আছে। মেয়ে দুটো আর ছোট ছেলেটা আছড়া-আছত করে কাঁদছে। বড় ছেলে, ছেলের বউ কাঁদছে। জামাইরা কাঁদছে।
তাকে দেখেই ছোট ছেলে আর্তনাদ করে উঠল, বাবা, তুমি আর একটা মিনিট দেড়টা মিনিট আগে এলে না? আর একটু আগে এসে কথা রাখতে পারলে না বাবা? যাবার দশ সেকেণ্ড আগেও মা যে চোখ তাকিয়ে চারদিকে খুঁজল তোমাকে?
মেজর ঘোষের এইবার মনে পড়েছে। তিনি কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন পাশে থাকবেন। কি আশ্চর্য, তিনি কি পাশে ছিলেন না এতক্ষণ?
অপর্ণার দিকে তাকালেন। ঘুমুচ্ছে যেন। হাসি-মাখা ঘুম। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ডেকে ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করবেন তার? বলবেন, শোনো অপর্ণা, আমি চেষ্টা করেছিলাম, আমিও তাই চেয়েছিলাম–চেয়েছিলাম!
নির্বাক, বোবা তিনি।
ঘণ্টাখানেক বাদে কান্নার প্রাথমিক আবেগ স্তিমিত হল। জামাইরা দেহ নেবার যোগাড়যন্ত্রে বেরিয়েছে। দুই ছেলে শিয়রে আর পায়ের কাছে বসে। পাশে তিনি।
ধরা-গলায় এক সময় বড় মেয়ে বলল, আর একটু যদি আগে আসতে বাবা…মায়ের কাছে তুমি শেষ কথাটা রাখতে পারলেই না……!
ক্লান্ত-ক্লিষ্ট মুখে মেজর ঘোষ চৌধুরী আস্তে আস্তে বললেন, হবার নয় বলেই হল না রে,…তিন-তিনবার রাস্তার লাল আলোয় আটকে গেলাম–বড় ক্রসিং, এক মিনিট করে থামতে হল। যাবার সময় অন্য রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই, অথচ লাল আলো, আর আসার সময় একেবারে বেরিয়ে মুখে-মুখে দুবার।
বড় ছেলে বেশ জোরেই বলে উঠল, বেরিয়ে আসার মুখে তো বেরিয়েই এলে না কেন? কে কি করত? বড় জোর একশ দেড়শ টাকা জরিমানা হত–এর বেশি আর কি হত?
মেজর ঘোষ চৌধুরী হতভম্ব বিমূঢ় হঠাৎ। বেরিয়ে আসা যেত ঠিকই। অনায়াসেই যেত। আর একশ দেড়শ টাকা ছেড়ে কথা রাখার জন্য এক হাজার দু হাজার দশ হাজারও বার করে দিতে আপত্তি ছিল না তার। কিন্তু লাল আলো দেখেও বিধি নাকচ করে ওভাবে বেরিয়ে আসা যেতে পারে সেটা মাথায়ও আসেনি তার। এখনো যেন ভালো করে আসছে না।
ছেলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন মেজর ঘোষ, চৌধুরী।