অপর্ণার নির্বাক চাউনিটা স্পষ্ট মনে আছে। দুচোখে জল টলমল করছিল।
.
গাড়ি থামল। এই দোকানই। নেমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। পরক্ষণে আরো বেগে ছুটে এসে গাড়িতে উঠলেন। মুখ শুকনো, চোখের নিমেষে গাড়ি ওধারের বড় রাস্তার দিকে ঘোরালেন৷
.
..অপর্ণা চললই তাহলে! বড় দোকানে ওষুধ মিলল না। মিলবে কিনা সন্দেহ ছিলই। পাওয়া গেলেও অপর্ণা থাকবে কিনা সন্দেহ–ডাক্তার তো তিনিও, আর নামী ডাক্তারই–সবই বোঝেন। তবু আশা, শহরের সব থেকে নামজাদা ডাক্তার বলেছেন, এই ওষুধটা একটা কেসএ জাদুর কাজ করেছিল–পান কিনা এক্ষুনি দেখুন। ওমুক জায়গায় যান—
সেই জন্যেই টেলিফোনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাঁচিয়ে নিজেই গাড়ি হাঁকিয়েছেন। আর কারো ওপর নির্ভর করতে পারেননি। ওষুধটা কোথাও থাকলে তাকে পেতে হবে। ওদিকের বড় রাস্তা ধরে গেলে আরো দুটে দোকান আছে।
কিন্তু ওদিকটায় আবার ট্রাম বাস মোটর চলাচলের ভিড়। তার ফাঁক দিয়েই বেগে। ছুটেছে। এই ওষুধটার জন্য তিনি যেন সর্বস্ব দিতে পারেন। টাকার তো অভাব নেই, অভাব যার ঘটতে চলেছে টাকা দিয়ে তা পূরণ হবে না।…অপর্ণা রাগই করত, সময়ে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই–তোমার এত টাকার কি দরকার?
মিলিটারি চাকরির যা পেনশন পান, সেদিকে তাকানোও দরকার হয় না তার। যে টাকা তিনি প্র্যাকটিস করে রোজগার করেন, তা কল্পনার বাইরে। সেই এক আট টাকা ভিজিট করে রেখেছেন তিনি–তাই রোগী আসে কাতারে কাতারে। প্রায় তিন বেলাই হিমসিম অবস্থা হয় তাঁর। বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে চেম্বার। কিন্তু খোঁড়া মেজরের কাছে রোগী আসে পাঁচ সাত মাইল দূর থেকেও। পা জখম হবার পর থেকে একটু খুঁড়িয়ে চলেন বলে রোগীদের মুখে মুখে এখন এই নাম।
ওয়ার্থলেস!
মুখ বিকৃত করে চার রাস্তার মুখ সবেগে পার হবার মুখেই ঘ্যাচ করে গাড়িটা থামাতে হল। লাল আলো। ভ্রূকুটি করে ওধারের রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে তাকালেন তিনি, গ্রীন পেয়ে এখনো নড়তেও শুরু করেনি। এই ফাঁকে অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারতেন। বাবুরা সব গদাই লস্করি চালে গাড়ি চালায়।
ঘন ঘন লাল আলোর দিকে তাকাচ্ছেন তিনি। অসহিষ্ণু হাতে পাশের হুইস্কির বোতল ট্রাউজারের পকেটে ঢোকালেন। গায়ে তো শুধু পুরু গেঞ্জি একটা।
.
সর্বদা অত ভয়ে ভয়ে থাকত বলেই একে একে হার্টের দুদিকেরই ভালব খারাপ হয়ে গেল কিনা অপর্ণার, মেজর ঘোষ চৌধুরীর এখন সেই সন্দেহ হয়। শয্যা নিয়েও তার দুশ্চিন্তা যায় না তার জন্য। ঘড়ি ধরা সময়ে খেতে না এলে বা সময়ে শুতে না এলে বিছানায় শুয়েই ছটফট করবে। ছেলেরা আর মেয়েরা অনেকবার সেই নালিশ করেছে। আর এখন তো মুখে কেবল এক কথা, শেষ সময়ে তুমি যেন কখনো আমার কাছছাড়া হয়ো না, কাছে থেকো–থাকবে তো?
মেজর ঘোষ হেসেছেন, শেষ সময় অত সস্তা নয়, বুঝলে?
–তবু তুমি কথা দাও- কথা দাও না গো!
কথা দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার তবু ভয় যায় না দেখে বিছানার গায়ে। টেলিফোন এনে দিতে হয়েছে। একটু খারাপ বুঝলেই অপর্ণা চেম্বার থেকে ডাকবে তাঁকে।
মা-কে বাবার এই কথা দেওয়ার খবরটা ছেলেমেয়েরাও কি করে যেন জেনেছে। মায়ের অসুখ বাড়বাড়ির দিকে গড়াবার আগে তারা এই নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। টেলিফোন হাতে পেয়ে ওদের মা যেন পরীক্ষা করার জন্যেই এ পর্যন্ত দিনতিনেক ডেকেছে তাকে।
গ্রীন লাইট। গাড়ি ছুটল।
.
দ্বিতীয় বড় দোকানেও নেই। চললই তাহলে অপর্ণা। মিথ্যেই দুর্বল হচ্ছেন তিনি, ওষুধ পেলেও যাবেই। তবু অন্য দোকানটাও দেখতে হবে। সময় নেই।…বাড়ির সঙ্গে কানে একটা টেলিফোন লাগানো থাকলে বুঝি ভালো হত। বাকি বড় দোকানটা দেখেই সোজা বাড়ি। তিনি কথা দিয়েছেন পাশে থাকবেন, সে-কথা যে কি-কথা সেটা এখন। অনুভব করছেন। যে অবস্থায় দেখে কেঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়েছেন–আর দেরি করা ঠিক হবে না।
আশ্চর্য! অপর্ণা কি তাহলে থাকবে এ-যাত্রা? ওষুধ পেয়েছেন। তিনি তো ডাক্তার, জীবন-মন্ত্র ভাবছেন নাকি এটা? ওষুধ হাতে পাবার পর আশাও তেমন করতে পারছেন কই? এই অবস্থা থেকেও ফেরে কেউ? সত্যি মিরাকল হয়?
এবারে আরো বেগে ছুটেছেন।
..খাইয়ে তো দেবেন, যেমন করে হোক কিছুটা পেটে যাওয়া চাই। চাই-ই।
ইমপসিবল! ইমপসিব! বিরক্তিতে অসহিষ্ণুতায় গলা দিয়ে জোরেই শব্দ বার করে ফেললেন মেজর ঘোষ চৌধুরী।
লাল আলো। অর্থাৎ থামো।
অথচ মাত্র দুটো সেকেণ্ডের জন্য বোধহয়। প্রথম সাদা দাগ ছাড়িয়েই এসেছিলেন। দ্বিতীয় দাগটা ছাড়াতে পারলেই আর থামতে হত না। কিন্তু তার আগেই সবুজ আলো হলদে হয়েছে, তারপর লাল। ও-ধারের রাস্তার গাড়ি স্টার্ট নেবার আগে এমন কি হলদে আলো সবুজ হবার আগেই তিনি হাওয়া হয়ে যেতে পারতেন।
কিন্তু কি আর করা যাবে! পিছনের দিকে দেখে নিয়ে দ্বিতীয় সাদা দাগের কাছ থেকে গাড়ি বরং হাতকয়েক পিছিয়ে নিতে হল।
..এ-রকম হয় না কেন, যে রাস্তায় গাড়ি যাবে সে রাস্তায় শুধু যাবেই, যে রাস্তায় আসবে, শুধু আসবেই–চার রাস্তা থাকবে না–এস রোড থাকবে না।
মাথা গরম হয়েছে বোধহয় তাঁর, কিন্তু এখানে বোতল খোলা মুশকিল।
নাকের ডগা দিয়ে যে গাড়িগুলো যাচ্ছে, সেগুলিকে ভস্ম করার চোখ মেজর ঘোষ চৌধুরীর।