দাঁতে করে বোতলের মুখ আটকে আবার পকেটে রাখলেন। স্পীডের কাটা প্রায় পঞ্চাশ ছুঁয়ে আছে। একটু আধটু কমছে, আবার পঞ্চাশের কাছে দাঁড়াচ্ছে। হাত একটুও কাঁপছে না মেজর ঘোষ চৌধুরীর। এজন্যেই আর কাউকে না পাঠিয়ে তিনি নিজে ছুটেছেন। আর্মিতে তার দুরন্ত গাড়ি ছোটানো দেখে কত লোকের তাক লেগে যেত। তিনি গাড়ি চালাবেন শুনলে ভয়ে অনেকে সে-গাড়ি এড়াতে চাইত।
…সেই অপর্ণা সত্যিই চলল তাহলে!
মেজর ঘোষ চৌধুরীর মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। কি কাণ্ড করেই না তিনি ঠিক-ঠিক ঘরে এনে ছেড়েছিলেন তাকে। অথচ এরই মাঝে কিনা তেত্রিশটা বছর কেটে গেল!
আবার দুচোখ চকচক করছে, আবার একটু একটু ঝাপসা দেখছেন। সেই সঙ্গে ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আভাসও।…তেত্রিশ বছর আগের নয়, মাত্র সেদিনের দৃশ্য যেন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে থেকে থেকে।
…ডাক্তারী পড়ার চতুর্থ বছর সেটা। পড়ার চাপ বেশি। একটা পাঁচমিশিলি নামী হস্টেলে থাকতেন। জানালা খুললেই পড়ায় ব্যাঘাত হত। অথচ না খুলেও পারতেন না। রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ীর মেয়ে অপর্ণা। নাম আরো দেড় বছর আগেই জানেন। তার যখন ডাক্তারীতে ফোর্থ ইয়ার, অপর্ণার তখন কলেজের থার্ড ইয়ার। সেই সময়ে গণ্ডগোলটা হল। এমন নতুন কিছুই করেননি। সেদিন চতুর্থ বছরের ডাক্তারী নবিশ ত্রিদিবেশ ঘোষ চৌধুরী রোজকার মতই মাঝে মাঝে জানালায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন, অন্য দিনের মতই মৃদু মৃদু হেসেছিলেন চোখাচোখি হতে। বাড়তির মধ্যে আভাসে। হয়ত বা কথা বলার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন।
ব্যস, অপর্ণা ঠাস করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করেছিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে অপর্ণার মারমুখী দাদা-কাকারা হস্টেলে এসে হাজির হয়েছিল। অন্য ছেলেরা তার হয়ে তুমুল বচসা করেছিল। আর তার কান দিয়ে আগুন ছুটেছিল। সেইদিনই ডাকে তিনি অপর্ণার নামে চিঠি ছেড়েছিলেন। সার কথা, একদিন তাকে তাদের বাড়ীতে তার ঘরে আসতেই হবে। ইচ্ছে হলে একথা সে তার বাবা মা দাদা কাকাদের জানিয়ে দিতে পারে।
মেজর ঘোষ চৌধুরী হাসছেন একটু একটু। ওই রকম গোঁয়ারই ছিলেন বটে। জানালায় এরপর আর খুব বেশি দাঁড়াতেন না। হঠাৎ একদিন কানে এলো–অপর্ণার বিয়ে পাকা হয়ে এসেছে। পড়াশুনা সিকেয় উঠল তার। মাথায় আগুন জ্বলল। একটা দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় ও বাড়ীর দূর-সম্পৰ্কীয় এক লোকের মারফৎ বার করলেন। কোথায় বিয়ে পাকা হয়ে এসেছে। ঠিকানাও সংগ্রহ করলেন। তারপর উড়ো চিঠি ছাড়লেন।–অপর্ণা এবং একটি ছেলে পরস্পরকে বিয়ে করবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ। অতএব ছেলের অন্যত্র বিয়ে করাই ভালো।
বিয়ে ভেঙে গেল। কারণও একেবারে গোপন থাকল মা হয়ত। কারণ দিনকতক বাদেই অপর্ণাকে হস্টেলের এই ঘরের দিকে চেয়ে তাদের জানালায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। আর ধীর পদক্ষেপে তিনিও নিজের জানালায় এসে দাঁড়ালেন। নিঃশঙ্কচিত্তে নির্দ্বিধায় স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিলেন তিনিই এই ব্যবস্থা করেছেন।
পরীক্ষা হয়ে গেল। তিনি হস্টেল ছাড়লেন। রেজাল্ট বেরুলো। ভালো পাস করলেন। অপর্ণা জানেও না তিনি কি পড়তেন বা কোথায় চলে গেলেন।
অভাবিত একটা ভালো সম্বন্ধ পেলেন অপর্ণার বাবা-মা একজনের মারফৎ। সেই একজন ত্রিদিবেশ ঘোষ চৌধুরীরই লোক সে আর কে বলতে গেছে। তারা জানালেন, বড়ঘরের ছেলে, বরাবর ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তার হয়েছে।
মিথ্যে জানলেন না তারা।
অপর্ণার বাবা নিজে এলেন খোঁজখবর করতে। এই ভদ্রলোক দেড় বছর আগের বিবাহের ঘটনা কিছুই জানেন না। তার সবই ভারী পছন্দ হল। এত সহজে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে আশা করেননি। ছেলের বাবা-মায়ের উদারতা দেখে তিনি মুগ্ধ। ছেলে দেখেও খুশি। মুখখানা চেনা চেনা লাগল। ফলে বাবা বলেই দিলেন, ছেলের পছন্দ বলেই তিনি এগোচ্ছেন, ছেলে মেয়ে দেখেছে–উল্টোদিকের হস্টেলই ছেলে থাকত।
জানাজানি হওয়া সত্ত্বেও বিয়েতে বিঘ্ন হল না। আর তারপর কটা দিন কি কাণ্ড! দুচোখ চকচক করছে মেজর ঘোষ চৌধুরীর, কিন্তু অল্প অল্প হাসছেনও।…বিয়ের পর অপর্ণা তার দিকে আর চোখ তুলে যেন তাকাবেই না, এমন অবস্থা।…সব যেন সে দিনের কথা মাত্র।
পিচের রাস্তা ঘষটে ঘ্যাঁচ করে থামল গাড়িটা। লাল আলো জ্বলে উঠেছে রেড লাইট! গলা দিয়ে অস্ফুট একটা বিরক্তির শব্দ বার করলেন মেজর ঘোষ চৌধুরী। সবুজ না হওয়া পর্যন্ত থাকো বসে! আরো অসহিষ্ণু বোধ করলেন তিনি, কারণ বিপরীত দিকে অর্থাৎ যে-দিকটার লাইন ক্লিয়ার–সেই রাস্তায় একটি গাড়ি আসছে না বা যাচ্ছে না। যান্ত্রিক ব্যবস্থায় সময় ধরে রোড সিগন্যাল পড়ে, এ-দিক বন্ধ তো ও দিক খোলা, ওদিক বন্ধ তো এ-দিক।
পকেটে হাত। হুইস্কির বোতল। খুললেন। গলায় ডাললেন। বন্ধ করে ওটা পকেটে রাখার অবকাশ পেলেন না– সবুজ আলো! বোতল পাশে পড়ে থাকল। গাড়ি ছুটল।
…সময় নেই।
আর্মিতে চাকরি নিতে অপর্ণা ঘাবড়েছিল। অনেক নিষেধ করেছিল, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার জন্য ঝকাঝকি করেছিল, তার ভয় তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। সর্বদাই ও যে একটা চাপা আতঙ্কে ভুগত সেটা তিনি টের পেতেন। সিভিল পোস্টিং হলে তবু স্বস্তি, সঙ্গে থাকত বলে অত ছটফট করত না। ইমারজেন্সি এরিয়ায় বদলী হলেই অপর্ণার আহার-নিদ্রা ঘুচত যেন। এই জন্যেই অসময়ে পূজো-আর্চা ধরেছিল বলে বিশ্বাস। মেজর ঘোষ চৌধুরী হাসতেন, আবার বিরক্তও হতেন।…লেফটানেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছেন, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর, তবু অপর্ণার ভয় ঘোচেনি। সে ছেলেমেয়েগুলোকে ঠিকমত মানুষ করে তুলেছে, তার প্রতি সকল কর্তব্য করেছে আর সেই সঙ্গে একটা অহেতুক ভয় পুষেছে। আশ্চর্য, দৈব বিড়ম্বনায় অসময়ে আর্মি। থেকে অবসর নিতে হল তাকে, তবু অপর্ণার ভয়ে ভয়ে থাকাটা যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। পাথর পড়ে পা ভাঙার ফলে আর্মির চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। মেজর ঘোষ চৌধুরী ঠাট্টা করেছিলেন, ঠাকুর তোমার ডাক শুনেছে, মিলিটারির চাকরি ছাড়িয়েছে!