সমর্থক প্রসঙ্গে সেবকরাম তার প্রিয় অফিসার ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর শরণাপন্ন হলেন। চতুর ক্যাপ্টেন ব্যানার্জী আবার এক ইংরেজ লেফটেনেন্ট কর্নেলকেই এনে দাঁড় করালেন সেবকরামের হয়ে সওয়াল করার জন্য–এমন লোক বাছাই করলেন যাঁর সঙ্গে ওই অফিসার কমাণ্ডারের খুব সদ্ভাব ছিল না। এই ইংরেজ লেফটেনেন্ট কর্নেল এসেই হৈ-চৈ কাণ্ড বাধিয়ে দিলেন, প্ররোচনার কারণ থাকলে কবে কোথায় কোন ইংরেজ সৈনিক অফিসারকে লাথি মেরেছিল তার নজির বার করলেন। অফিসার কম্যাণ্ডার অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেনকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেটা অস্বীকার করেননি। সেটাই তো প্ররোচনা! নিপুণ সুদক্ষ কর্মী সেবকরামের দেশপ্রীতির জন্য শাস্তি না। হয়ে তার পুরস্কার পাওয়া উচিত বলে গলা ফাটালেন তিনি।
হুলস্থুল বেধে গেল এই নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অফিসার কম্যাণ্ডারের সম্মান রক্ষার্থেই কোর্ট মার্শালে মাত্র একমাস কারাদণ্ড হল সেবকরামের। হাবিলদার মেজরের পদমর্যাদা অবশ্য গেল, দণ্ডের মেয়াদ ফুরালে আবার সিপাই থেকেই কাজ আরম্ভ করতে হবে তাকে।
ওদিকে সেবকরামের দেশে পর্যন্ত নানাভাবে পল্লবিত হয়ে এই খবর চলে গেছে। সেখানে তিনি বারের আসন লাভ করেছেন। ঝুমরিবাঈ ঘোষণা করেছেন, জেল থেকে। বেরুলে সেবকরামকেই বিয়ে করবেন তিনি। তার বাবা এবারে হৃষ্টচিত্তে সায় দিয়েছেন।
জেল থেকে বেরিয়েই সেবকরাম দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে সেই কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন যাঁকে তিনি পদাঘাত করেছিলেন। দুজনে দুজনকে দাঁড়িয়ে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত। সাহেব এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হ্যাঁণ্ডশেক করলেন। হেসে বললেন, আমার মাজায় এখনো ব্যথা আছে!
নিজে কাধ ধরে নিয়ে গিয়ে কাজে বহাল করলেন, আর তক্ষুনি আবার হাবিলদার মেজরের পদে প্রমোশন দিলেন তাকে।
বিয়ে কর্মস্থলেই হল। কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন বউ দেখতে এলেন। এসে এক ফাঁকে খুশী হয়ে বউকে বললেন, বি কেয়ারফুল; হি ক্যান কিক্ ওয়েল!
হাবিলদার মেজর সেবকরাম সলজ্জে হেসে এই প্রথম ক্ষমা চাইলেন তার কাছে। বললেন, সাহেব, সেই দিন ঝুমরির বাবা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল আর এই দেখো বলে গলার লকেটটা তাকে উল্টে দেখিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সেই ব্যথার ওপর তুমি আরো কোথায় ব্যথ্যা দিয়েছিলে দেখো-এই দেশ যে আমার প্রাণ সাহেব! সাহেবের দুই চক্ষু চকচক করছিল। একবার ঝুমরিকে দেখছিলেন তিনি, একবার কেরামের গলার লকেটটা।
এরপর কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন ক্রমশ অনেক ওপরে উঠেছেন, পুরোদস্তুর কর্নেল হয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে অলক্ষ্য থেকে সেবকরামকেও টেনেছেন। সকলে অবাক হয়ে দেখেছে–হাবিলদার মেজর সেবকরাম হঠাৎ ভাইসরয়েস কমিশনড় অফিসার হয়েছেন একদিন–লেফটেনেন্ট হয়েছেন। তারপর প্রশস্ত রাস্তা, লেফটেনেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন থেকে মেজর। এর অনেক আগেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কর্নেল ব্রাউন বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু যাবার আগে তিনি এঁদের সঙ্গে দেখা করে যেতে ভোলেননি। সেই পুরনো ঠাট্টাও করেছেন মিসেস সেবকরামের দিকে চেয়ে, হি কি ওয়েল–দ্যাট ওয়ান ব্রিলিয়ান্ট কিক ব্রট বোথ ইউ অ্যাণ্ড মি নিয়ারার–ডোন্ট ইউ এগ্রি উইথ মি ম্যাডাম?
সৈনিক
অপর্ণা এবারে সত্যিই চলল তাহলে! অনেক দিন যাবে যাবে করেছে, অনেক দিন বলেছে সময় হয়ে এলো। মেজর ঘোষ চৌধুরী এ-কানে শুনে ও-কান দিয়ে বার করে দিয়েছেন। অপর্ণা উপেক্ষা ভেবেছে কিনা কে জানে! সদা ব্যস্ত স্বামীর কান মন সজাগ নেই ভাবত কিনা কে জানে! নইলে অত করে বলত কেন?
ভিড়ের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি রেড রোডে পড়তেই স্পিডের কাটা তিরিশ থেকে এক লাফে পঁয়তাল্লিশের দাগে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু সে কাটা কেউ দেখছে না। মেজর ঘোষ চৌধুরী ঘড়ির কাঁটা দেখলেন একবার। বেলা চারটে বাজতে দশ। রাস্তা ফাঁকা। কতক্ষণ আর লাগবে। যাবেন আসবেন। এই জন্যেই আর কাউকে না পাঠিয়ে নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছেন। প্রতিটা মুহূর্তের অনেক দাম এখন। মরণ-বাচনের দাম। জীবনের একটাই মিনতি রাখা না-রাখার দাম। না, একটানা তেত্রিশ বছরের যুক্ত জীবনে অপর্ণার আর কোনো প্রার্থনা বা মিনতি এই মুহূর্তে অন্তত মনে পড়ছে না মেজর ঘোষ চৌধুরীর। অপর্ণা বলেছিল, তুমি এত ব্যস্ত, তাই ভয় হয়। শেষ সময়ে কাছে থেকো, নইলে ভয়ানক খারাপ লাগবে আমার–থাকবে তো?
একবার নয়, অনেকবার করে বলেছিল। এই গত পরশুও বলেছিল। কালও একবার বোধহয় বলতে চেষ্টা করেছিল। আর আজ সকাল থেকে মুখে বলতে না পারুক হঠাৎ-হঠাৎ তাকিয়ে দেখেছিল তিনি আছেন কিনা।
চোখদুটো ভয়ানক চকচক করছে মেজর ঘোষ চৌধুরীর। অথচ ঝাপসা ঝাপসা দেখছেন। কঁচাপাকা লোমশ দুই পরিপুষ্ট হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন। একটা হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকল। হুইস্কির ছোট বোতল বেরুলো। দাতে করে মুখ খুললেন। রাস্তাটা ফাঁকা, তাছাড়া কে দেখল না দেখল পরোয়া করেন না। দরকার বলেই খাচ্ছেন। মাথা ঝিমঝিম করলে চলবে না, চোখে ঝাপসা দেখলে চলবে না। সময়ের অনেক দাম এখন। হাত শক্ত, স্নায়ু সবল রাখা দরকার। ছোট বোতল উপুড় করে গলায় ঢাললেন খানিকটা। অর্ধেকের বেশিই খালি হয়ে গেছে গত দু-ঘণ্টার মধ্যে। সাধারণত বেশি খান না। দুদিন ধরে বেশিই খাচ্ছেন। দুদিনে এরকম চারটে ছোট বোতল খালি। হয়ে গেল…না, দিস ইজ দি ফোর্থ, খালি হতে চলেছে!