এবারে মেজর বিড়ম্বিত। চারদিক থেকে তরল রব উঠেছে, দেখব, দেখব–উই মাস্ট সি!
সভাপতি হাত বাড়াতে নিরুপায় মেজরকে গলা থেকে হারটা খুলে দিতে হয়। তারপর সেই লকেটসুদ্ধ হার সকলের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। সকলের মুখেই। শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম।
লকেটের পিছনে সুন্দর করে খোদাই করা ভারতের মানচিত্র, তার মধ্যে ভারতমাতা দাঁড়িয়ে।
পার্টি শেষ হতে গাড়ি বাড়ির দিকে ছুটেছে। পিছনের সীটে মেজর এবং মিসেস সেবকরাম দুজনে দুধারে বসে। মাঝখানে ফুলের বোঝা। তাঁদের ছদ্ম গাম্ভীর্যে ফাটল ধরছে মাঝে মাঝে। আড়ে আড়ে এক-একবার দুজনেই দুজনকে দেখে নিচ্ছেন।
ফুলের আড়াল দিয়ে একখানা হাত মিসেস সেবকরামের হাতে ঠেকল। ড্রাইভারের অলক্ষ্যে তিনিও ঈষৎ আগ্রহেই হাতখানা ধরলেন।
গাড়ি নির্দিষ্ট পথে ছুটে চলেছে।
.
এবারে বহুকালগত মেজরের জীবনের সেই স্মরণীয় ঘটনাটি ব্যক্ত করলে এই কাহিনী সম্পূর্ণ হতে পারে।
সেই নতুন বয়সে মেজর সেবকরাম ছিলেন এক তোপখানার হাবিলদার মেজর। হাবিলদার মেজর থেকে হওয়া আর মন্ত্রী দপ্তরের আরদালী থেকে মন্ত্রী হওয়া প্রায় একই পর্যায়ের বিচিত্র ব্যাপার। মেজর সেবকরাম তাই হয়েছিলেন।
ইংরেজ আমলে তোপখানার তিনি সিপাই হয়ে ঢুকেছিলেন। খাওয়া পরা ছাড়া। তখন মাইনে ছিল মাসে আট টাকা। অল্প লেখাপড়া জানতেন, সাহেবী আমলের ভাঙা ইংরেজী বলায় তার সুনাম ছিল। আর ছিল প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা। ফলে ওপরের অফিসার ক্যাপ্টেন ব্যানার্জীর প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। সিপাই থেকে নায়েক হয়েছেন, নায়েক থেকে হাবিলদার এবং সেই অল্প বয়সেই হাবিলদার থেকে মেজর। মাইনে তখন অলফাউণ্ড কুড়ি টাকা–তাদের পর্যায়ে সেদিনের। মস্ত চাকরি। হাবিলদার মেজর নিজের ইউনিটের জোয়ানদের মধ্যে সর্বেসর্বা। তাঁকে ডিউটি ভাগ করে দিতে হয়, জোয়ানদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়। জোয়ানেরা যেমন সমীহ করত তেমনি ভালও বাসত তাকে। মোট কথা সেই অল্প বয়সেই জোয়ানদের আকাঙ্ক্ষার স্বর্ণচূড়ায় উঠে বসেছিলেন হাবিলদার মেজর সেবকরাম।
কিন্তু এই উন্নতির তেমন কদর ছিল না শুধু ঝুমরির বাবার কাছে।
সেবকরাম ফৌজে চাকরি করে, বছরের ছুটিতে একবার মাত্র দেশে আসে, কোনো গণ্ডগোল বাধলে কোথায় কোথায় চলে যেতে হবে জামাইকে– এইসব ভেবে ঝুমরির বাবার এই বিয়ে মনঃপূত ছিল না। তার থেকে ফলের ব্যবসায়ী প্রভুজীর ছেলেকেই বেশি পছন্দ তার।
ঝুমরি সেবকরামের পড়শিনী, ছেলেবেলা থেকে ভারী ভাব দুজনের। বড় হয়ে ফৌজে ঢোকার ফলে সেবকরাম ভেবেছিলেন তার কদর বাড়ল। কিন্তু উল্টো ব্যাপার দেখে তার চক্ষুস্থির। পারলে তক্ষুনি চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু ফৌজের চাকরিতে একবার ঢুকলে ছাড়তে প্রাণান্ত। ঝুমরির বাবাকে চিঠিপত্রে অনেক বোঝালেন তিনি। ওদিকে ঝুমরিবাইও দোটানায় পড়লেন, গোলামী করতে যাওয়াটা তার আদৌ পছন্দ ছিল না। তাছাড়া বাপও ন্যায্য কথাই বলছেন মনে হল, বিয়ের পরেও তো জীবনের অর্ধেক ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকা।
কর্মস্থলের প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে মায়ের লেখা ওদের শেষ জবাব পড়লেন সেবকরাম। মা লিখেছেন, ওরা শেষ পর্যন্ত এই বিয়েতে রাজি হল না।
চিঠি পড়ে সেবকবামের দুনিয়া রসাতলে পাঠানোর আক্রোশ। পায়ে পায়ে তিনি চললেন টেন্ট-এর দিকে।
এদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে এক নতুন ক্যাপ্টেন এসেছেন তখন। গ্রাউণ্ডে দাঁড়িয়েই তিনি তাকে কম্যাণ্ডিং অফিসার–অর্থাৎ এই ইউনিটের সর্বাধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল ব্রাউনের কাছ থেকে কিছু জ্ঞান আহরণ করছিলেন। জোয়ানদের ভালোভাবে জেনে বুঝে পরিচালিত করার সুবিধে হয় এরকম কোনো বই আছে কিনা খোঁজ করছিলেন। নতুন উৎসাহী ক্যাপ্টেনটি।
লেফটেনেন্ট কর্নেল ব্রাউন জবাব দিলেন, আছে কিন্তু তার কিছু দরকার নেই। জাস্ট গিভ দেম এ কিক অন দি ব্যাক অ্যাণ্ড দে উইল ডাই ফর ইউ! অর্থাৎ পিছনে একটি করে লাথি কসাবে, তাহলেই তারা তোমার জন্যে প্রাণ দেবে।
ঠিক সেই সময়েই সেবকরাম তাঁদের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন কানে আসতে দাঁড়িয়ে গেলেন আর কম্যাণ্ডিং অফিসারের জবাব শুনে পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এলেন। তারা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে।
পিছন থেকে আচমকা এক বিপুল পদাঘাতে তিন হাত দূরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কম্যাণ্ডিং অফিসার ব্রাউন। নবাগত ক্যাপ্টেন বিমূঢ় হঠাৎ। কম্যাণ্ডিং অফিসার মটি থেকে উঠে দেখলেন পিছনে কে দাঁড়িয়ে।
সেবকরাম শান্ত মুখে প্রশ্ন করলেন, ইউ মিন হি সুড কিক দিস ওয়ে সর? অর্থাৎ, কি এইভাবে লাথিটা মারতে বলছেন কে?
কম্যাণ্ডিং অফিসারের কোমরে রিভলভার থাকলে হয়ত তক্ষুনি সব শেষ হয়ে যেত। তার হাতে ছিল একটা স্টিক। তাই নিয়েই বাঘের মত সেবকরামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর লপটা-লপটি দুজনে।সেবকরামের কপাল ফেটেছে, কম্যাণ্ডিং অফিসারেরও নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই ব্যাপার ঘটে গেল। তারপরেই লোকজন ছুটে এলো। সেবকরামকে অ্যারেস্ট করা হল, নিরস্ত্র করা হল।
এরপর কোর্ট মার্শাল। যুদ্ধের সময় হলে এই অপরাধে সেবকরামের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে জানা কথাই।
কোর্ট মার্শাল শুরু হল। আইন অনুযায়ী নিচু পর্যায়ের তিনজন ভারতীয় অফিসার ও থাকবেন। তারা চেষ্টা করতে লাগলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যদি বারো-চৌদ্দ বছরে এনে দাঁড় করানো যায়। এদিকে এই বিচারে আসামী নিজেরও একজন সমর্থক বা আইনজ্ঞ দাঁড় করানোর রীতি। যত টাকা খরচ হোক, সরকার তাকে আসামীর ইচ্ছানুযায়ী এনে দিতে বাধ্য।