কৃকমল চ্যাটার্জীর এখন সর্বসাকুল্যে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে এ হত্যা করেছেন।
বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড ঘা খেয়েছেন কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী। বড় মেয়ের বিয়ে নিলেন মস্ত বনেদী ঘর দেখে। মানুষ দেখেননি তেমন করে। বড় মেয়ের আত্মহত্যর পর একটানা বছরখানেক কেস চালিয়েছিলেন তিনি মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ী আর জামাইয়ের বিরুদ্ধে। ফল হয়নি।
মেজ মেয়েরও ঘটা করে বিয়ে দিয়েছিলেন এক মস্ত ব্যবসায়ীর ঘরে। বিশেষ অবস্থাপন্ন তারাও। তাদের আবার চালচলন জাঁকজমক এত বেশি যে তাই থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। তার ওপর মেজ জামাইয়ের নাক তাদের পরিবারের মধ্যে সব থেকে বেশ উঁচু। তুচ্ছ রেষারিষি বড় বিরোধে দাঁড়িয়েছে–মেজ জামাইটি নিজেও দূরে সরেছেন, মেয়েকেও দূরে সরিয়েছেন।
বড় ঘরে মেয়ে দেবার সাধ মিটেছে ভদ্রলোকের। ছোট মেয়ের বয়স তখন। সোলও নয়, কিন্তু তখনই সঙ্কল্প করেছেন আর বড় ঘর নয়। মেয়েকে কারো হাতে দেবেন না, বরং মেয়ের হাতের মুঠোয় কাউকে এনে দেবেন।
তাই দিয়েছেন।
.
বিয়েটা যখন হয়েই গেল, অর্থাৎ কল্পনার আকাশকুসুম যখন সত্যিই বাস্তব জীবনে খসে পড়ল, গৌরকিশোরের বয়স তখন ছাব্বিশ-লতার একুশ। কিন্তু বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই তাদের বয়সটা বিপরীত খাতে বইতে লাগল। গৌরকিশোর বুঝি সবে না-বালকত্বের গণ্ডী ছাড়িয়েছেন, আর লতার পাকাঁপোক্ত সাবালিকার ভূমিকা।
ছোট মেয়ে, বাপের আদরের মেয়ে বাবাকে পছন্দ করতেন, আর বাবার মুখে শুনেছিলেন চমৎকার ছেলে গৌরকিশোর–তাই চমৎকার যে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বিয়ের আগে তাকে দেখে ততটা চমৎকার লাগল না। বাবার কৃষ্ণকমল নাম ভারী ভালো লাগে তার, গৌরকিশোর নামও সেই গোছের ভালো লেগেছিল। বেশ ধারালো অথচ একখানা মিষ্টি মুখ তিনি কল্পনা করেছিলেন। প্রথম দর্শনেই হোঁচট খেল। তারপর দিনে দিনে হোঁচট খেতে লাগল। ধারের চিহ্নও নেই কোথাও, আর। মিষ্টি অর্থে যদি আনুগত্য হয়, তাহলে মিষ্টিই বটে।
ভিতরে বাইরে এমন এক বর্ণশূন্য লোকের সঙ্গে বাপ তার বিয়ে দিলেন কি করে তিনি ভেবে পাননি। চেনা-জানা যে কটি লোক বিয়ের আশায় ঝুঁকেছিল বা ঝুঁকতে চেয়েছিল, তাদের যে-কেউ এর থেকে অনেক ভালো ছিল। লতার কেবলই মনে হত, অনুগত জামাই আনার তাড়নায় বাবা সব থেকে বেশি অবিচার করেছেন তারই ওপর।
বিয়ের মাসতিনেকের মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে বারকয়েক আনুষ্ঠানিক যাতায়াত করেছেন তিনি। জামাইকে ডেকে বাবা নিজেই তারপরে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিধবা মা বা ভাই-বোনদের প্রতি কর্তব্যের ব্যাপারে তাঁর সহানুভূতির অভাব নেই, কিন্তু মেয়ে সেখানে থাকতে পারবে না। তার বড় বাড়ির পাশে ছোট বাড়িটা মেয়ের কথা ভেবেই তিন বছর ধরে খালি রেখেছেন তিনি–মেয়েকে নিয়ে আপাতত সেখানেই থাকতে হবে। মেয়ের নামে অভিজাত এলাকায় বেশ খানিকটা জমি কেনা আছে –ধীরেসুস্থে সেখানে বাড়ি করা হলে তারপর অন্য ব্যবস্থা।
শ্বশুরের ব্যবস্থা জামাইয়ের মনঃপূত কিনা সে-প্রশ্ন অবান্তর। গৌরকিশোরের পৈতৃক বাড়ির সচ্ছলতায় সত্যিই টান ধরেনি, কিন্তু বিনিময়ে বড় কাছের একজনকে খোয়াতে হয়েছে তাদের। মাঝেসাঝে মাকে দেখতে আসেন গৌরকিশোর। এই আসাটাও কমে আসছে। এ নিয়ে বাড়ির কারো অভিযোগ নেই। থাকলেও মুখে অন্তত কেউ কিছু বলে না। কিন্তু দেখা হলে একজন বলেন।
সুমিতা।
গৌরকিশোরের এক মামীর বোনের মেয়ে। সুরসিকা আর ঠোঁট-কাটা। কাছাকাছি বাড়ি, তাই আত্মীয়তার থেকে ঘনিষ্ঠতা বেশি। এম, এ, পড়ার সময়ে মনের তলায়। সুমিতাকে ঘিরে কিছু মিষ্টি সম্ভাবনাও উঁকিঝুঁকি দিত। খুব সংগোপনে। বছর আড়াই মোটা মাইনেয় চ্যাটার্জী মেটাল-এ চাকরি করার পর সেই সম্ভাবনা নিজের মধ্যেই দানা পাকিয়ে উঠেছিল। সুমিতার এম, এ, পরীক্ষার পরই একটা প্রস্তাব উত্থাপনের বাসনা ছিল গৌরকিশোরের। তার আগেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। অবশ্য সে জন্য চক্ষুলজ্জার কারণ নেই। সেই সাময়িক দুর্বলতার খবর সুমিতার জানার কথা নয়। খেদও নেই। বিত্ত বা বৈভব ছেড়ে বড় ঘরের মেয়ের রূপের টানও অন্য রকম।
দেখা-টেখা হলে এই সুমিতাই ঠাট্টার ছলে ঠাসঠাস কথা শুনিয়ে দেন। স্কুল মাস্টারি করে মুখ আরো ঢিলে হয়েছে। এক মুখ হেসে সেদিন মায়ের সামনেই বলেছিলেন, বাবারে বাবা, গৌরদা তুমি দেখালে বটে, রাধিকার জন্যে স্বয়ং ব্রজকিশোরও এভাবে স্বজন ছেড়েছিল বলে শুনিনি!
মা বলেছিলেন, তুই থাম তো
আরো বেশি হেসে সুমিতা প্রতিবাদ করেছিলেন, আমি থামতে যাব কেন? আপনাদের ঘরের ছেলে, আপনারা মুখ বুজে থাকুন।
বিয়ের পর শ্বশুর স্টিল অ্যাণ্ড নেট অ্যায়ারিং-এর নতুন শাখা খুলেছেন! তার সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়েছেন ছোট ছেলে আর জামাইকে। আর পুরনো অফিস থেকে কিছু সুযোগ্য কর্মচারীও দিয়েছেন।
কিন্তু লতার তবু দুশ্চিন্তা হয়েছিল। ছোড়দা আছেন সঙ্গে তাতে যেটুকু স্বস্তি। নইলে ওই মানুষের আলাদাভাবে ব্যবসা দাঁড় করানোর ক্ষমতা আছে এ বিশ্বাস তার আদৌ নেই।…আগাগোড়া পরীক্ষায় প্রথম হল কি করে, তার ওপর অঙ্কে, সেটাই তার কাছে বিস্ময়। সার্টিফিকেটগুলো না দেখলে বিশ্বাস হত না।