কিন্তু প্রসাধনরত মিসেস সেবকরাম আজ হাসছেন অন্যকারণে। আজকের বিশেষ পার্টি বিশেষ করেই তাদের জন্যে–সেই কারণেও নয়। জীবনের এক বিরাট অধ্যায় শেষ হয়ে গেল, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করছেন মেজর সেবকরাম–সেই বিদায়। উপলক্ষে এই সাড়ম্বর পার্টি। কিন্তু মিসেস সেবকরামের ঠোঁটের ফাঁকে কৌতুকের। হাসিটুকু লেগে আছে একেবারে ভিন্ন কারণে। আজও এই খানিক আগে স্বামীর সঙ্গে সেই চিরাচরিত ব্যাপার নিয়ে ছদ্ম বাকবিতণ্ডা হয়ে গেছে একপ্রস্থ। ঠোঁটের হাসিটুকু তারই রেশ। মেজর বলেছিলেন, যার জন্যে জীবনের ঠিক এইখানটায় আজ এসে দাঁড়ানো গেছে, তাকে সত্যি সত্যি কেউ চিনল না।
মিসেস সেবকরাম হাসি চেপে দেয়ালের মস্ত অয়েলপেন্টিং ছবিটা দেখিয়ে নিরীহ মুখে জবাব দিলেন, কর্নেল ব্রাউনের কথা বলছ?…চিনবে না কেন, মস্ত নামী লোক তার ওপর তোমার মত এমন একজন মেজর তৈরি করে গেল!
সেবকরাম মাথা নেড়েছেন, কর্নেল ব্রাউন নয়, আমি আমার ঝুমরির কথা বলছি। আজকে এই জায়গায় এসে দাঁড়ানোর পিছনে ঝুমরিবাঈয়ের কেরামতি কতখানি কেউ জানলই না, বোকাগুলো জীবনভোর শুধু আমাকেই বাহবা দিয়ে গেল।
মিসেস সেবকরামের নাম ঝুমরিই বটে, ঝুমরিবাঈ। কিন্তু এখন ভদ্রলোকটিও তাকে ঝুমরি বলে ডাকলে লজ্জা-লজ্জা করে–কেমন ছেলেমানুষ লাগে নিজেকে। ছেলেদের সামনে ডাকলে তো চোখ রাঙান তিনি। মহিলাদের উদ্যোগের কোনো চাঁদার খাতাটাতায় সই করতে হলেও সংক্ষেপে লেখেন মিসেস জে, সেবকরাম। ঝুমরিবাঈ শুনলে তবু একরকম, শুধু ঝুমরি শুনলে বয়স যেন অর্ধেক কমে যায়।
সেই রকমই ভ্রূকুটি করেছিলেন ঝুমরিবাঈ, এই প্রসঙ্গ উঠলে যেমন করে থাকেন। বলেছিলেন, হু, আমার কেরামতি কত জানা আছে! আসলে যার কেরামতি সে তোমার ওই গলায় ঝুলছে–তোমার এই চাটুবাক্যে যে ভুলবে সে একটি আস্ত বোকা!
মেজরের গলায় ঝুলছে বড় লকেটসুষ্ঠু একটা হার। আজ ছত্রিশ বছর ধরেই এটা গলায় ঝুলছে তার। ছত্রিশ বছর আগে প্রথম যখন ফৌজের চাকরিতে ঢোকেন তিনি–তার ঠাকুরদা এটি উপহার দিয়েছিলেন তাকে।
উপদেশ দিয়েছিলেন, মন্ত্রপূত কবচের মত এটি যেন সর্বদা গলায় রাখা হয়। ঠাকুরদা ছিলেন দূর অতীতের স্বাধীন মারাঠা বীর সৈনিকবংশের সন্তান।
পরদেশী ফৌজে চাকরি নেবেন তাঁর নাতি এটা আদৌ মনঃপূত ছিল না। নিলেনই যখন, এটা তখন তার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার দেশের সম্মান তোমার গলায় থাকল। সেই থেকে অনেকবার হার ছিঁড়েছে আর বদলেছে, কিন্তু মূল জিনিস অর্থাৎ সেই লকেট তেমনি আছে। ঝুমরিবাঈ এটা ইঙ্গিত করেই মুখঝামটা দিয়েছিলেন। আর তারপর প্রসাধন করতে করতে আপনমনেই হাসছিলেন।
.
সভার মধ্যে মেজর যে এই কাণ্ড করে বসতে পারেন, ঝুমরিবাঈ তা কল্পনাও করেননি।
জীবনের যে একটি বিশেষ ঘটনা মেজরের কর্মজীবনে সোনার অক্ষরে চিহ্নিত হয়ে আছে, সেই কাহিনীটিই আন্তরিক আনন্দে সভার বৃদ্ধ সভাপতি জুনিয়র অফিসারদের শোনালেন। মেজরের সেই কাহিনী অনেকে অনেকবার শুনেছে, তবু বরাবরকার মতই সরস লাগল আবারো। আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। ঝুমরিবাঈ তখনো খুশিতে গর্বে মাঝে মাঝে স্বামীর মুখখানা দেখে নিচ্ছিলেন। এবারে মেজরের কিছু বলার পালা। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, আমি এই দীর্ঘদিন ধরে খানিকটা অপরের প্রাপ্য অপহরণ করে আসছি। আজকের বিদায়ের দিনে সেটুকু স্বীকার করে যাওয়াই ভালো–এইমাত্র জীবনের যে ঘটনা– শুনে আপনারা আমাকে অভিনন্দন। জানালেন তার সবটুকু আমার প্রাপ্য নয়।
এ পর্যন্ত বলে তিনি অদূরে ঝুমরিবাঈয়ের দিকে তাকালেন একবার। মিসেস সেবকরামের শঙ্কটাপন্ন অবস্থা দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে তিনি যেন নীরবে নিষেধ করতে চেষ্টা করলেন। এখানকার হুল্লোড়ের ব্যাপার তিনি জানেন।
কিন্তু মেজর তা দেখেও দেখলেন না, উৎসুক শ্রোতাদের দিকে চেয়ে বলে গেলেন, বয়সকালে একটি মেয়েকে মনে ধরেছিল আমার, তাকে বিয়ে করার জন্য ভিতরে ভিতরে ক্ষেপেই উঠেছিলেন, কিন্তু তখন ফৌজে সেই সামান্য চাকরি করি আর জীবনটা কবে আছে কবে নেই ভেবে সেই মেয়ের বাপ আমার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে রাজি নন। যেদিন আমি ওই কাণ্ড করে আপনাদের কাছে ফেমাস হয়েছিলাম, ঠিক তার আগেই বিয়ের নাকচপত্র এসেছিল। ফলে আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলছিল–এবং যা আমি করে বসেছিলাম সেই মেয়েটিকে না পাওয়ার সম্ভাবনার প্রতিক্রিয়াতেই বোধ। হয় করতে পেরেছিলাম। অতএব আমার সেই ছেলেমানুষি বীরত্বের সঙ্গে একটি মেয়েরও পরোক্ষ কৃতিত্ব জড়িত ছিল–সেদিনের সেই মেয়েটি উনি–ওই মিসেস সেবকরাম।
হিয়ার হিয়ার! হিয়ার হিয়ার! ওয়াণ্ডারফুল! আরো শুনব! আরো শুনতে চাই আমরা!
আনন্দে খুশিতে সভাস্থল সরগরম। মিসেস সেবকরামের মুখ টকটকে লাল। আনন্দোচ্ছল অজস্র জোড়া দৃষ্টির আঘাতে তিনি ফাঁপরে পড়লেন।
মেজর সেবকরাম গম্ভীর। বললেন, আপনারা আজ আমায় বিদায় দিচ্ছেন, কিন্তু উনি তো দিচ্ছেন না। তাই নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি আর একটি কথাও বলব না।
সভা এইবার মিসেস সেবকরামকে নিয়ে পড়ল। তাঁকেও কিছু বলতেই হবে। বিব্রত বিড়ম্বিত মুখে মিসেস সেবকরামকে উঠে দাঁড়াতে হল। শ্রোতারা উন্মুখ।
মিসেস সেবকরাম বললেন, পুরুষেরা মেয়েদের চিরদিনই নির্লজ্জ তোষামোদ করে থাকেন, মেজরের উক্তি সেই নির্লজ্জতারই চরম নিদর্শন। আসলে কার অপমান বরদাস্ত করতে না পেরে তিনি সেদিন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই বিচিত্র কাণ্ড করে বসেছিলেন, তার সঠিক প্রমাণ আছে আপনাদের মেজরের গলার ওই হারের লকেটটিতে। আপনারা ওটি দেখলে খুশি হব।