এই ঠাট্টার পরেই অবশ্য দুর্দৈব ঘটেছিল। চীনা আক্রমণে হিমালয়ের শান্তি নড়ে উঠেছিল। তখন এক এক কর্মক্ষেত্রেরই আবার আর এক রূপ দেখেছেন মিসেস সেবকরাম। সার্ভিসের লোকগুলোকে নিয়ে যেন হরির লুট লেগেছিল। কে কোথায় ছিটকে পড়েছিল ঠিক নেই। আজ যে এখানে কাল সে কোন সীমান্তে ঠিক নেই। সেদিনের কথা মনে পড়লেই একখানা হাসি-হাসি-মুখ বুকের তলায় খচখচ করে মিসেস সেবকরামের। তার থেকে অনেক ছোট অথচ কি নজরে যে দেখেছিল তাকে, কে জানে।–ক্যাপ্টেন বিঠঠল; বড় জোর চল্লিশ হবে বয়স। মিসেস সেবকরাম কোন পাটিতে গেলেই কাছে কাছে ঘুরঘুর করত, তিনি এদিক ওদিক তাকালেই পাঁচবার করে ছুটে আসত কিছু চাই কিনা জিজ্ঞাসা করতে। চাই বললে খুশি হত, চাই না। বললে মুখখানা বেজার করত। মিসেস সেবকরাম তার ওপরঅলার স্ত্রী, সেই হিসেবে। কিছুটা অনুকম্পার পাত্র। তা এসব পার্টিতে লেডিদের অনুকম্পার পাত্র সকলেই—-সে লেফটেনেন্ট কর্ণেলই হোক আর নবাগত লেফটেনেন্টই হোক। সম্মিলিত পার্টিতে সামান্য অফিসারের স্ত্রীর রাজরাণীর মর্যাদা।
তবু বড় অফিসারদের স্ত্রীদের ছোট অফিসাররা নিজেদের অগোচরেও কিছুটা সমীহ করে থাকে। কিন্তু সেদিন ক্যাপ্টেন বিঠলের পানের মাত্রা বোধ হয় একটু বেশী হয়ে গিয়েছিল। সবিনয়ে চুপি চুপি প্রস্তাব করেছিল, মাদাম, আজ যদি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে নাচেন! মিসেস সেবকরাম পার্টির এই অধ্যায়টা বরাবর সন্তর্পণে পরিহার করে এসেছেন। আঠার-কুড়ি বছর বয়স থেকেই এই এক ধকল তাঁকে সামলে আসতে হয়েছে। বুড়ো বুড়ো ওপরঅলা অফিসারগুলো পর্যন্ত হ্যাংলার মত এই অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছে। কিন্তু মিসেস সেবকরাম নাচ শেখেনইনি মোটে। গোড়ায় গোড়ায় মেজর চেষ্টা করেছিলেন শেখাতে–অবশ্য চেষ্টা যখন করেছিলেন তখন তিনি মেজর নন, নতুন বয়সের লেফটেনেন্ট। ছদ্ম কোপে তখন চোখ পাকিয়েছেন মিসেস সেবকরাম, তোমাদের মিলিটারী চাকরিতে এত বউ ধরে টানাটানি কেন, নিজেরা যা করছ করোগে।
কিন্তু এই বয়সে বিঠঠলের ওই প্রস্তাবে যেমন অবাক হয়েছেন তেমনি বিরক্ত হয়েছিলেন। মেজরকে বলেছিলেন, ছোকরার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করো, ওর মাথায়। গণ্ডগোল হয়েছে, আজ আবার আমার সঙ্গে নাচতে চেয়েছিল!
মেজর সেবকরাম হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, এবার থেকে তোমার বয়সের একটা কার্ড তুমি গলায় ঝুলিয়ে যেও।
সেই ক্যাপ্টেন বিঠঠলের বিদায় পার্টি ছিল সেদিন–সুদূর ফ্রন্ট-এ হাজিরা দেবার নির্দেশ এসেছিল তার উপর। বিদায় সম্বর্ধনার পরে মেজরের সামনেই সে এসেছিল মিসেস সেবকরামের কাছে। সৌজন্যের রীতি অনুযায়ী মিসেস সেবকরাম তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, সুস্থ পরমায়ু কামনা করেছিলেন। ছেলেটা চুপচাপ খানিক তাকিয়েছিল তার দিকে, তারপর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল, আপনার হাতখানা ধরতে। পারি?
মিসেস সেবকরাম বিব্রত বোধ করেছিলেন, ওদিকে স্বামী নীরবে একটু ইশারা করেছিলেন। মিসেস সেবকরাম একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দুই হাতে প্রগাঢ় আবেগে সেই হাতখানা নিয়ে নিজের ঠোঁটে ঠেকিয়েছিল ক্যাপ্টেন বিঠঠল। তারপরেও ধরে রেখেছিল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সসম্ভ্রমে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল, মাদাম, এই দুটো বছর আপনাকে বড় ভালো লেগেছে। হাসি-খুশি দরদ মর্যাদাবোধ–সব মিলিয়ে আপনাকে দেখলেই মনে হয়েছৈ, ইউ রিপ্রেজেন্ট মাদার ইণ্ডিয়া।
মিসেস সেবকরাম স্বামীর দিকে চেয়ে দেখেছেন, চোখ দুটো তার অদ্ভুত চকচক করছে। দেশের প্রসঙ্গে এই চোখ তিনি জীবনে অনেক দেখেছেন।
মাসখানেকের মধ্যে ফ্রন্ট থেকে ক্যাপ্টেন বিঠঠলের মৃত্যুসংবাদ এসেছে। তার। বীরত্ব আর দুঃসাহসিক মৃত্যুবরণের বিবরণও এসে পৌঁচেছে। সকলে গর্ব অনুভব করেছে। গোপনে অনেকবার চোখের জল মুছেছিলেন মিসেস সেবকরাম।
এর কিছুদিন বাদেই নিজের স্বামীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। মেজরকে হাজিরা দিতে হয়েছে সুদূর লদাকে। সেই দীর্ঘ সময়টা কি ভাবে কেটেছিল মিসেস সেবকরামের তিনিই জানেন। এই দুটো ঘটনার পর থেকে বাকি একটা বছর পার্টির অনেক প্রগলভ হৈ-চৈ এমন কি অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অশালীন ফুর্তি দেখেও তিনি বিরক্ত হননি।…আহা, কে কবে আছে আর নেই কে জানে, জীবনের তো এই দাম সব!
কিন্তু আজ নিজের খুশির আমেজেই সুচারু প্রসাধন সম্পন্ন করছেন মিসেস সেবকরাম। তার বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। চুলের বোঝার ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলোতে পাক ধরেছে। কিন্তু সাজগোজ করে পার্টিতে গেলে সেখানকার পঞ্চাশোর্ধরা তার দিকেই বেশি ঘেঁষে। মেজরের এখন আটান্ন, সব চুল সাদা। দুই ছেলে মিলিটারী কলেজে ভবিষ্যৎ সৈনিক হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মেজর ঠাট্টা করেন, আমার সঙ্গে তোমার পার্টিতে যাওয়ার অনিচ্ছার কারণটা বুঝতে পারি, ছেলেদের যখন বড় বোন ভাবে লোকে তোমাকে, আমাকে কি ভাবে কে জানে!
এই বেপরোয়া রসিকতারও হেতু আছে। ছেলেরা সেবারে ছুটিতে বাড়ি আসতে একজন সদ্য পরিচিত ভদ্রলোক মিসেসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এঁরা দুটি আপনার ছোট ভাই নাকি?
কিন্তু মুখে যাই বলুন মেজর, তার ওই চুলই শাদা হয়েছে। এখনো চওড়া বুকের ছাতি, পরিপুষ্ট হাতের কজা। আনন্দে অনেক নব্য তরুণের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেন। যখন, তাদের কাঁধের হাড়ে লাগে। এই রসিকতা শুনলেই মিসেস সেবকরাম রাগ করেন আবার হেসে ফেলেন।