.
আসামী বিভাবতী চট্টোপাধ্যায়ের কথাবার্তা শুনে তরুণ ম্যাজিষ্ট্রেট কৌতূহল বোধ করছেন বেশ। ঘরের অনেকে হাসছেও মুখ টিপে। একধারে শুধু নতুন মেয়ে জামাই, বর্ধমানের মেয়ে জামাই আর ছেলের মুখ শুকনো।
বিভাবতী উকীল দেননি। বর্ধমানের মেজ জামাই সে চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খেয়ে বিরত হয়েছে। শাশুড়ী বলেছেন, নিজের ওকালতি নিজেই তিনি করতে পারবেন, এর জন্যে লোক ভাড়া করার দরকার নেই।
করেছেনও। তার বক্তব্য, স্বামীর উনিশ হাজার টাকা সম্বলের মধ্যে দশ হাজারের ওপর খরচ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যত ভাবতে গেলে চোখে অন্ধকার দেখার কথা–এই খরচ তিনি সখ করে করেননি, ফুর্তি করার জন্যও না। করার দরকার হয়েছিল তাই করেছেন।
তিনি স্বীকার করেছেন, দুশ লোক নেমন্তন্ন করা হয়েছিল, আর যা-যা খাওয়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ, তাও সবই স্বীকার করেছেন, শুধু তিনি দোষী এটুকুই অস্বীকার করেছেন।
তরুণ বিচারক প্রশ্ন করলেন, পঞ্চাশজনের বেশি লোককে এসব খাওয়ানো নিষেধ, আপনি জানতেন না?
জানতাম। এরকম রাজ্যি-ছাড়া নিষেধ আমাদের ভিতরে পৌঁছয় না।
কেন?
কেবল নিষেধ, আর কেবল নেই! সত্যিই নেই বুঝতে পারলে কারো নিষেধ করার দরকার হত না।
সম্ভব হলে বিচারক এই আসামীটিকে মুক্তিই দিতেন বোধ করি। একেবারে ন্যুনতম লোক-দেখানো শাস্তিই ঘোষণা করলেন তিনি। বিভাবতীর পঁচিশ টাকা জরিমানা হল, অন্যথায় তিন দিন জেল।
তিন দিন জেলের উক্তি নিয়ম-রক্ষার্থে, পঁচিশ টাকা জরিমানাতেই এই বিচার-পর্ব শেষ হবে জানা কথা। কিন্তু আসামীর প্রশ্ন শুনে ভিতরে ভিতরে হয়ত অস্বস্তিই বোধ করলেন বিচারকটি। বিভাবতী তার দিকে স্থির তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পঁচিশ টাকা জরিমানা না দিলে তিন দিন জেলে থাকতে হবে?
তরুণ বিচারক মাথা নাড়লেন।
আপনাদের জেলে ভদ্রঘরের মেয়েদের রাখার ঠিক ঠিক ব্যবস্থা সব আছে তো?
বিব্রত মুখে আবারও মাথা নাড়তে হল বিচারককে। তারপর তেমনি বিড়ম্বিত। মুখে তার আত্মীয়-পরিজনদের দিকে তাকালেন তিনি।
বিভাবতী বললেন, পঁচিশ টাকা দেবার আমার ক্ষমতা নেই, তিন দিন জেলেই থাকব। ছেলে আর মেয়েদের দিকে ফিরলেন তিনি, তোরা বাড়ি যা-তিনটে দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর সাবধান ব্যাণ্ডেলে যেন কেউ কিছু না জানায়।
নিরুপায় জামাই দুটি শাশুড়ীর অলক্ষ্যে বিচারকের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে কি বোঝাতে চেষ্টা করল তারাই জানে। তিনি উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তারাও অদৃশ্য। একটু বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরল তারা। বিভাবতী অবাক হয়ে দেখলেন তাঁকে কেউ জেলখানায় নিয়ে যেতে এলো না। শুধু মেয়েরাই খুশিমুখে এগিয়ে এলো। শম্পা বলল, চলো মা, এবারে বাড়ি চলো– তুমি দেখালে বটে, হাকিম তোমার জরিমানা মকুব করে দিয়েছেন।
জরিমানা সত্যিই যে এভাবে মকুব করা যায় না, বিভাবতীর তা জানার কথা নয়। তবু সন্দিগ্ধ। জামাইদের দিকে তাকালেন, সত্যি না তোমরা জরিমানা গুনে দিয়ে এলে?
প্রাণের দায়ে মেজ জামাই আর নতুন জামাই ঘন ঘন মাথা নাড়ল। আর মেয়েরা বলে উঠল, তোমার কাছে মিথ্যে বলার সাহস আছে নাকি আমাদের, চলো শিগগীর।
আশ্বস্ত হয়ে সকলকে নিয়ে বিভাবতী বাইরের বারান্দায় এসেই তপ্ত মুখে গজ গজ করে উঠলেন, আমাদের সময় মা-বাবা শ্বশুর-শাশুড়ীরা বলত, কখনো নেই বলতে নেই- আর এদেশের লোক হয়ে আইন করে হাঁকডাক করে নেই-নেই রব তুলে দিয়েছে একেবারে–লজ্জাও করে না!
পরক্ষণে কি মনে পড়তে থমকালেন একটু, পা-ও থেমে গেল। ছেলের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, এখনো তো বেলা পড়েনি, তুই এক কাজ কর তো, এক্ষুনি ব্যাণ্ডেলে চলে যা, তোর বাবাকে নিয়ে আয়–কি ভাবে আছে কে জানে, সঙ্গে টাকা আছে? আছে? যা তাহলে–যাবি আর আসবি, আর সাবধানে নিয়ে আসবি
গল্পটা এই।
তখনো ভাবছিলাম আমি। ভাবছিলাম অর্থাৎ নামী আর মোটামুটি নামী লেখকদের মত আর মন্তব্য বিশ্লেষণ করছিলাম।
দীর্ঘদিন ধরে নিজে সাহিত্য করছি, কঠিন বাস্তবের পটভূমিতে অনেক গল্প লিখেছি, আর সেই সঙ্গে কড়া সম্পাদক হিসেবে কিছু সুনাম আর দুর্নাম কুড়িয়েছি। তবু সতীর্থদের মতামত আর মন্তব্যের সঙ্গে নিভৃতের অনুভূতির তেমন যোগ হচ্ছে না কেন?
প্রথম, নতুন লেখক যে বলেছে, গল্পটা সত্যের ছায়া নিয়ে লেখা–সেটা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না কেন?
দ্বিতীয়, বিভাবতীর যে কথাবার্তা আচার-আচরণ লেখক বন্ধুদের অবাস্তব মনে হয়েছে, তার একবর্ণও বদলালে গল্পটা বর্ণশূন্য হয়ে যাবে মনে হচ্ছে কেন?
তৃতীয়, গল্পটা নিছক উদ্দেশ্যমূলকই যদি হয় তো, ও-রকম একটি মহিলাকে সচক্ষে দেখার লোভ হচ্ছে কেন?
চতুর্থ, শ্রোতা-লেখকদের মন্তব্য অনুযায়ী গল্প থেকে হার্টের রোগী ভদ্রলোকটিকে উড়িয়ে দিয়ে, অর্থাৎ মহিলার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়ে এই গল্পটা জটিলতা-মুক্ত করে। তোলার কথা ভাবতেও বুকের ভিতরে বাতাসের অভাব বোধ করছি কেন?
আর সব শেষে, যে মেয়ের মঙ্গল আর কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায় মহিলার উনিশ হাজার টাকা সম্বলের থেকে দশ হাজার খরচ করার প্রেরণা আর অনায়াসে আইন ভঙ্গ করার তাড়না- কল্পনায় সেই মেয়ের মাথায় হাত রেখে কেন বলতে ইচ্ছে করছে, মঙ্গল হোক, সুখী হও!
গল্পটা ছাপব কিনা এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি।
মেজর সেবকরাম
সন্ধ্যার পর আজ বেশ একটু সময় নিয়ে আর বেশ একটু যত্ন করে প্রসাধন পর্বে মনোনিবেশ করেছেন মিসেস সেবকরাম। মুখখানা হাসি-হাসি। হাসি-হাসি কেন, আয়নায় নিজের দিকে চেয়ে মাঝে মাঝে হাসছেনও মিটিমিটি। কিছুদিন আগেও পার্টি শুনলে গায়ে জ্বর এসেছে। গোমড়ামুখ করে প্রসাধন সেরেছেন। বিশেষ করে মেস ক্লাবের ডিনার পার্টি শুনলে না যাবার ফিকির খুঁজেছেন এই বয়সেও। যে হৈ-হুঁল্লোড় কাণ্ড সব, বয়সের বাছবিচার নেই, ছেলে-বুড়োতে মিলে ফষ্টি-নষ্টির হাট! মিসেস সেবকরাম একবার এক বছরের একটা লিস্ট করেছিলেন–গোটা বছরে কতগুলো পার্টি হল। তাতেও অফিস পার্টি অর্থাৎ যাতে তাদের নিমন্ত্রণ নেই, সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন। তারপর কর্তাকে ঠাট্টা করেছিলেন, মিলিটারী চাকরি মানে তো শুধু পার্টি আর পার্টি!