কেন, আমি তো ভালই আছি।
আঃ, যাবে তুমি?
তৎক্ষণাৎ প্রস্থান। স্ত্রীর মন ভালো না, জানেন। বড় মেয়ের শরীর খারাপ, বাচ্চাটার আরো খারাপ–তাকে আনতে পারেনি। স্ত্রীর চোখে কতবার যে জল এসেছে আর শুভদিনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় সেই জল ঠেকিয়ে রেখেছে–সে শুধু তিনিই জানেন। বড় মেয়ে আসতে না পারার দরুন স্ত্রীর এত মন খারাপ দেখেই তারও মনটা বিষণ্ন।
ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন তিনি, জামা-কাপড় ছাড়লেন না– একটু বিশ্রাম করে স্ত্রীর মন বুঝে আর একবার ওদিকে যেতে চেষ্টা করবেন। যে দুধ নিয়ে আসবে তারই মারফৎ স্ত্রীর অনুমতি চেয়ে পাঠাবেন।
আধ ঘণ্টার মধ্যে দুধের গেলাস হাতে স্ত্রীই হাজির। তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন শৈলেশ চাটুজ্জে, আবার তুমি কেন?
ঘামে জবজব করছে বিভাবতীর মুখ, আর পরিশ্রমে বড় বেশি লাল হয়েছে। এক চুমুকে দুধের গেলাস খালি করে জল খেলেন শৈলেশ চাটুজ্জে, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, সব খেতে বসে গেছে?
এক ব্যাচ হয়ে এলো। তোমার কেমন লাগছে এখন?
খুব ভালো, একবার ঘুরে আসব?
না, তোমাকে এক্ষুনি ব্যাণ্ডেলে যেতে হবে, বিশু ঠাকুরপোর নতুন গাড়িটা পেয়েছি, তোমার কিছু কষ্ট হবে না–পাকা ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
শৈলেশ চাটুজ্জে হতভম্ব হঠাৎ। কি শুনছেন ঠিক যেন বুঝছেন না। বিশু ঠাকুরপো মানে তার বড়লোক বাল্যবন্ধু বিশ্বেশ্বর ঘোষ? বললেন, আমি–মানে এখন ব্যাণ্ডেলে যাব?
হ্যাঁ, সবে তো রাত আটটা এখন, দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। কেবলই মনে হচ্ছে মেয়েটা ছটফট করছে আর কাঁদছে–জামা-কাপড় তো পরাই আছে দেখছি, এই টাকা কটা রাখো, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর দেরি কোরো না, এক্ষুনি চলে যাও। গাড়িতে টিফিন ক্যারিয়ারে রমা আর ওদের সকলের জন্য খাবার দিয়েছি–খায় যেন। আর তুমি গিয়েই যেন কাল-পরশুর মধ্যে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ো না, এই গণ্ডগোলের মধ্যে থাকলে তোমার হার্ট আরো খারাপ হয়ে যাবে। তিন চার দিনের মধ্যে এদিকের সব চকলে আমিও যাচ্ছি–একসঙ্গে ফিরব। এই নাও, পকেটে তোমার ওষধ কটা নিয়ে নাও।
কথা বলারও ফুরসত পাচ্ছিলেন না শৈলেশ চাটুজে। এবারে বললেন, কিন্তু আজই কেন…কাল না হয় যাব…তাছাড়া আমি তো এখন বেশ…
গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তুমি উঠবে? তুমি না গেলে এক্ষুনি আমি যাব!
যাচ্ছি, যাচ্ছি, কিন্তু
আর কিন্তু না, শিগগীর ওঠো! লক্ষ্মীটি, তুমি মেয়েটার কাছে না গেলে আমার একটুও ভালো লাগছে না। এদিকে আমি সব সামলে নিতে পারব
শৈলেশ চাটুজ্জে নীরবে তাকালেন একবার। তার মনে হল, স্ত্রীর চোখে জল বুঝি ভেঙেই পড়বে। আর একটি কথাও না বলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। তারপর নিঃশব্দেই গাড়িতে এসে উঠলেন। গাড়িটা চলে গেল।
বিভাবতী স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বিয়েবাড়ির দিকে চললেন। শুকনো দুচোখ খরখর করছে এখন।
হ্যাঁ, দশ মিনিট সময় নিয়েছিলেন, তার মধ্যেই ফিরেছেন তিনি।
বিয়েবাড়ির এদিকটায় চাপা উত্তেজনা একটা। বিভাবতী জানেন কিসের উত্তেজনা, কেন উত্তেজনা?
স্থির পায়ে এগিয়ে এসে পাশের একটা ছোট ঘরে ঢুকলেন তিনি। সেই ঘরে তিনজন পুলিশ এবং দুজন তাদের ওপরঅলা ভদ্রলোক।
তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিভাবতী, কি বলবেন বলুন?
প্রধান অফিসারটি বললেন, যাঁর মেয়ের বিয়ে তিনি কোথায়?
আমারই মেয়ের বিয়ে।
সিঁথির সিঁদুরের দিকে চোখ গেল অফিসারের।
আপনার স্বামী কোথায়?
তিনি অসুস্থ, কলকাতায় নেই। আমার বড় মেয়েও অসুস্থ, আসতে পারেনি, তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
অফিসারের চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তিনি এখানে নেই?
না। বললাম তো তিনি অসুস্থ, হার্টের রোগী, বাড়িতে ডাক্তারের প্রেসকৃপশন আছে একগাদ, দেখতে পারেন।
নেমন্তন্ন চিঠি কার নামে ছাপা হয়েছে?
নেমন্তন্ন চিঠি ছাপানো হয়নি, ওসব বাজে খরচ করার পয়সা নেই।
একজন কেউ তো দাঁড়িয়ে থেকে ব্যবস্থা করিয়েছেন, তাকে ডাকুন।
আমিই দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করেছি, আর কেউ করেনি।
ও…। অফিসারের তির্যক দৃষ্টি, লোক তো অনেক দেখছি, কত লোক খাওয়াচ্ছেন?
দু’শ।
লিখে নিলেন। কি খাওয়াচ্ছেন একবার দেখতে চাই।
দেখলে খেয়ে যেতে হবে। আসুন–
অফিসার কেন যেন এগোতে পারলেন না। বললেন, অপরাধ নেবেন না, আমরা কর্তব্যের দায়ে এসেছি, খেতে পারব না।
আমি কর্তব্যে বাধা দেব না, খেয়ে গেলে আমার মেয়ের কল্যাণ হবে। এখানেই আনিয়ে দিচ্ছি
না না না। অফিসার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মহিলার দিকে চেয়ে অস্বস্তি বোধ করছেন কেন। আচ্ছা আপনি বলুন, কি খাওয়াচ্ছেন?
লুচি মাছ মাংস পোলাও দই রসগোল্লা সন্দেশ
অফিসার লিখে নিলেন। সক্কলের জন্য এই ব্যবস্থা?
সক্কলের জন্য।
আবার লিখলেন। তারপর আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু এসব তো আইনে নিষেধ করা আছে…একটু মুশকিল হলো!
আমাকে এখুনি থানায় যেতে হবে?
অফিসার মুখ তুলে তাকালেন, কিন্তু চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। একটু ভেবে বললেন, না, আপনি যা বললেন…এতে একটা সই করে দিলেই হবে।
খাতাটা বাড়িয়ে দিলেন, কলম এগিয়ে দিলেন।
আঁকা-বাঁকা অক্ষরে বিভাবতী নাম সই করলেন। নির্দেশমত বসতবাড়ির ঠিকানাও লিখে দিলেন।
সদলবলে অফিসার চলে গেলেন। ঘরের বাইরের চাপা উত্তেজনা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল আবার। এদিকের একটা ঘরে কি ঘটে গেল, বিয়েবাড়ির অন্দরমহলের কেউ কিছু জানতেও পারল না।