মাথা নাড়ল খাইয়েছে।
তিনি সটান নিজের ঘরে চলে গেলেন।
বেরিয়ে মেয়ের ঘরে এলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে। শম্পা শয্যায় বসেছিল। সচকিত।
চুপচাপ তিনি মেয়েকে দেখলেন একটু। বললেন, সামনের এই দশ দিনের মধ্যে বিয়ে দিতে চায় ওরা–তা না হলে ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক এই তিন মাস আর হবে না।
বুকের ভিতর থেকে শম্পার একটা বোঝা নেমে গেল। আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকাল সে। কিন্তু মায়ের মুখখানা যেন অদ্ভুত শান্ত মনে হলো তার। আর তারপর যা ঘটল শম্পা কল্পনাও করতে পারে না। মা হঠাৎ পাশে বসে পড়ে দুহাতে বুকে টেনে নিল তাকে। তারপর আরো আশ্চর্য, মায়ের চোখে জল বুক চেপে ধরে মা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আনন্দের আবেগে শম্পা দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
বিভাবতী নিঃশব্দে তার পিঠে হাত বুলোচ্ছেন।
.
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন বিভাবতী। সমস্ত গা কাঁপছে। ঘামছেন দরদর করে। ঘন অন্ধকার।
এ কি দেখলেন তিনি? এ কি দেখে উঠলেন?
তিনি দেখলেন, ঘুমের মধ্যে একেবারে স্পষ্ট দেখলেন, বিগত শ্বশুর খাচ্ছেন আর হাসছেন হাসছেন আর খাচ্ছেন। মাছ মাংস পোলাউ রসগোল্লা সন্দেশ সব পরিপাটি করে খাচ্ছেন। খাচ্ছেন আর বলছেন, বেটি সেয়ানা বটে, বেশ করেছে, নিজেরটা নিজেই যোগাড় করে নিয়েছে! খেয়ে বড় তৃপ্তি হল গো বউমা।
এ রকম স্বপ্নও দেখে কেউ? বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি, দিবারাত্র নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই বিভাবতীর। এই কদিনে তিন ঘণ্টা করেও ঘুমিয়েছেন কিনা সন্দেহ। বেশি রাতে শুয়েছিলেন আজও। বিছানায় গা ঠেকানো মাত্র ঘুমিয়েছেন। তার মধ্যে এই স্বপ্ন।
সকালে উঠেও অনেকক্ষণ বিমনা তিনি। কদিন ধরে ভিতরটা তার খুঁতখুঁত করছিল ঠিকই। আবার সেই জলযোগের ব্যবস্থার নামে গায়ে জ্বর আসছিল। কেবলই ভাবছিলেন কি করা যায়! স্বপ্ন দেখা আশ্চর্য নয়, কিন্তু শ্বশুর এভাবে খাচ্ছেন আনন্দ করছেন এই স্বপ্নই কল্পনাতীত।
ছেলের পক্ষ ধরেই নিয়েছে, শুধু মেয়েটি ঘরে আসবে, তার সঙ্গে আর বেশি কিছু নয়। তবু যতটা পারা যায় করবেন ঠিক করেছিলেন বিভাবতী। মেয়ের বরাতে বড় ঘর জুটেছে, অতিরিক্ত ভালো জামাই জুটেছে। মেয়ের বড় ভাগ্যটা তিনি একেবারে ছোট করে শুরু করাবেন না। যথাসাধ্য করবেন। এই যথাসাধ্য করার হিসেব দাঁড়িয়েছে আট হাজার টাকা। বিভাবতীর কল্পনার বাইরের অঙ্ক প্রায়। স্বামী প্রভিড়ে ফাণ্ড গ্রাচুইটি ইত্যাদির ইত্যাদির সব টাকা কুড়িয়েবাড়িয়ে সর্বসাকুল্যে উনিশ হাজার টাকা তার হাতে দিয়েছিলেন। ওই যথাসর্বস্ব। ছেলে না দাঁড়ানো পর্যন্ত আর কপর্দক ঘরে আসারও সম্ভবনা নেই। তবু তাই থেকে আট হাজার টাকা খরচ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন বিভাবতী।
স্বপ্ন দেখার ফলে বিকেলের মধ্যে প্ল্যান আরো অনেকটা প্রশস্ত রাস্তায় এগিয়ে চলল। কাউকে কিছু না বলে বাসে চেপে ভাগ্নের বাড়ি চলে গেলেন তিনি। ভাগ্নেটা করিতকর্মা লোক। তার সঙ্গে বসে নতুন করে আর একটা হিসেব করে ফেলা হল। দুশ সোয়া দুশ লোককে পেটপুরে খাওয়াতে কম করে আরো দু হাজার টাকা লাগবে। যা তিনি খাওয়াতে চান, এর কমে হবেই না।
বিভাবতী বললেন, ঠিক আছে, তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও। সব যোগাড়যন্ত্র করতেও তো প্রাণান্ত ব্যাপার!
সেদিক থেকে ভাগ্নে তাকে নিশ্চিন্ত করল।
খুশিমনে বিভাবতী বাড়ি ফিরলেন। তার মস্ত একটা দুর্ভাবনা গেল। কেবলই মনে হল, মেয়ের কল্যাণের জন্য শ্বশুরই এভাবে তার দ্বিধা ঘুচিয়ে দিলেন। পরে যা হবার হবেই। আর এতে মেয়ের মঙ্গলও হবেই। ইতিমধ্যে সকালেই তিনি পাড়ার বিয়েবাড়ির একতলা ভাড়া করে এসেছেন। নিজেদের আড়াই ঘরে কিছুই হবে না। বাড়ি থেকে মিনিট তিনেকের পথ ওই বিয়েবাড়ি। দোতলায় বাড়ির মালিক থাকে, একতলা বিয়ের দরুন ভাড়া দেওয়া হয়। তা সেও শ্বশুরের আশীর্বাদে আর মেয়ের ভাগ্যে একটু সুবিধেতেই পেয়েছেন তিনি। বিয়ের দিন সকাল থেকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য ভাড়া একশ টাকায় রফা হয়েছে।
খরচ আট হাজার থেকে এক লাফে দশ হাজারে উঠে গেল। কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনায় একটুও উতলা নন তিনি। মেয়ের কল্যাণ হবে মেয়ে সুখী হবে এটাই যেন বড় কথা।
বাড়ির কর্তা অর্থাৎ শৈলেশ চাটুজ্জে খোঁজ নিতে চেষ্টা করেন, কি হচ্ছে বা কি হবে! বিভাবতী ধমকেই ঠাণ্ডা করেছেন তাকে, যা হবে তা হবে, তোমাকে কে মাথা ঘামাতে বলেছে? ভাবনা-চিন্তা করে আবার হার্ট ধরে বসে পড়ো!
আমতা আমতা করে ভদ্রলোক বলেন, ইয়ে, আমি তো বেশ ভালই আছি এখন।
বিভাবতী রেগে যান, ভালো আছ সেটা আর সহ্য হচ্ছে না, কেমন? তাহলে তুমিই সব ব্যবস্থা করো, আমি গিয়ে শুই!
স্বামীটি সুড়সুড় করে ঘরে পালিয়ে বাঁচেন।
কিন্তু ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন বিয়ের রাতে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়েবাড়ির এলাহি ব্যাপার দেখে কি রকম যেন অস্বস্তি বোধ করেছেন তিনি। এক-একবার এক-একদিকে ঘুরে দেখছেন, আবার চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকছেন।
অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর দিকে চোখ পড়ল বিভাবতীর। তক্ষুনি ছেলেকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে ছাড়লেন তাকে। বললেন, বিয়ে তো হয়ে গেছে, এখন ঘরে গিয়ে খানিক চুপচাপ শুয়ে থাকোগে যাও–একটু বাদে আমি দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।