সব গোছগাছ করে নিজের ভাত বেড়ে ঢাকা দিয়ে রেখে বিভাবতী হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কি জন্যে যে ঠাকুর তাঁকে এই দৃশ্য দেখালেন কে জানে! নইলে আজ তো তার ব্যাণ্ডেল থেকে আসারই কথা না।…মোড়ের মাথায় যেখানে বিভাবতীর বাস থেকে নামার কথা, তার খানিক আগেই নেমে পড়তে হয়েছিল। সামনে একগাদা গাড়ি আটকে গেছে, তাই নেমে পড়েছিলেন। গরমে সেদ্ধ হওয়ার থেকে এই দুমিনিট হাঁটা ভালো।
নেমে ওধারের ফুটপাথ ঘেঁষে আসছিলেন তিনি। ওখানে একটাই হালফ্যাশনের নামী রেস্তরাঁ আছে। ঘাড় ফেরাতেই হতভম্ব কয়েক মুহূর্ত। কোণের দিকে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসে খাচ্ছে শম্পা আর কে একটা ছেলে। দুজনে দুজনের দিকে ঝুঁকে কথা কইছে, এত নিবিষ্ট যে কোনদিকে চোখ নেই কারো।
ছেলেটার চেহারাপ ভালো, আর জামাকাপড়ও ফিটফাট। বিভাবতীর মাথায় তখন দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠেছে–কলকাতার পথেঘাটে অমন ভালো চেহারা ফিটফাট হাড়-পাজী ছোকরা তিনি অনেক দেখেছেন।
কিন্তু স্বামীকে ওষুধ খাইয়েই তক্ষুনি আবার ফিরে এসে মেয়ের ওপর চড়াও হন নি তার প্রথম কারণ, মেয়েটা আরো ভয় পাবার অবকাশ পাক, দ্বিতীয় কারণ, তিনি কিছু ভাবছেন আর কিছু মনে করতে চেষ্টা করছেন।
নিঃশব্দে মেয়ের ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করলেন তিনি। মেয়ের ফর্সা মুখ কাগজপানা হয়ে আছে দেখলেন। কাছে আসতেই শম্পা কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
বোস!
দাবড়ানি খেয়ে বসে পড়ল আবার। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।–ওই লাল বাড়ির ছেলে মানে গাঙ্গুলি জজের বাড়ির ছেলে?
গাঙ্গুলি জজ বিশ বছর আগে পেনশন নিয়েছেন। পাড়ায় তাদের নামডাক প্রতিপত্তি মন্দ নয়।
শম্পা ঘাড় গোঁজ করে সামান্য মাথা নাড়ল।
গাঙ্গুলি জজের কে হয়?
ছেলে। শম্পার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না প্রায়।
কোন ছেলে?
ছোট।
পড়াশুনা কতদূর করেছে?
এক বছর আগে এম. এ. পাশ করেছে।
বিভাবতী তীক্ষ্ণ গভীর দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে নিলেন একটু। মেয়ে সত্যি বলছে কিনা সেটাই বোঝার চেষ্টা হয়তো!–এখন কি করে?
কলেজের প্রোফেসারি। শম্পার গলায় কি একটু আশার সুর বাজল? সাহস করে সে কি মুখ তুলে মায়ের মুখের দিকে একবার তাকাবে? পারল না।
বিভাবতী জিজ্ঞাসা করলেন, তোর সঙ্গে কদিন ধরে আলাপ?
শম্পা নিরুত্তর।
কদিন? বিভাবতী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন আবার।
দু বছর।
বিভাবতী হতভম্ব খানিক। তারপরেই দাঁত কড়মড় করে বলে উঠলেন, দু বছর ধরে আমার চোখে ধুলো দিয়ে তুই এই করে বেড়াচ্ছিস? তোর দিদিদের বিয়ের আগে থেকে?
শম্পার মুখ বিমর্ষ আবার। কেঁদে ফেলে বলে উঠল, তুমি বিশ্বাস করো মা, ও খুব ভালো ছেলে।
বিভাবতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন খানিক। তারপর বললেন, কাল থেকে আমি না বলা পর্যন্ত তুই কলেজে যাবি না, আর বাড়ি থেকে এক পা বেরুবি না।
একে একে দুটো স্তব্ধ দিন কেটে গেল।
তৃতীয় দিনে লাল বাড়ির ছেলে কলে পড়ল। বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিল, বিভাবত কাজের অছিলায় বেরুলেন, তারপরেই খপ করে ছেলেটার হাত ধরে বললেন, তোমার বাড়িই যাচ্ছিলাম, ভিতরে এসো আমার সঙ্গে।
বিমূঢ় তটস্থ লাল বাড়ির ছেলেকে সোজা বাড়িতে টেনে নিয়ে এলেন তিনি। এনে তাকে নিয়ে সোজা শম্পার ঘরেই ঢুকলেন।
শম্পা আঁতকে উঠে দাঁড়াল।
তুই ও ঘরে যা!
হুকুম অমান্য করার মত বুকের পাটা নেই। করুণ চোখে একবার লাল বাড়ির। ছেলের দিকে তাকিয়ে শম্পা দুরুদুরু বক্ষে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বোসো।
চৌকির এক কোণে কাঠ হয়ে গেল ছেলেটা।
কি নাম?
সুনীল গাঙ্গুলী।
কি করো?
কলেজে পড়াই।
কোন কলেজে?
নাম বলল।
বিভাবতী এর পর বাড়িতে কে আছে না আছে, দাদারা কি করে না করে ইত্যাদি খবর নিলেন। বোনেদের কোথায় বিয়ে হয়েছে তাও শুনলেন। সবই মোটামুটি বড় ব্যাপার।
আমাদের অবস্থা কি জানো?
লাল বাড়ির ছেলে সুনীল মাথা নাড়ল–জানে।
আমাদের কিছু নেই জেনেও তোমার বাবা-মা এখানে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন?
তারা রাজি হয়েছেন।
তুমি তাদের বলেছ?
হ্যাঁ। বাবা-মা শম্পাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে দেখেছেন, আলাপ করেছেন। এখন আপনাদের দিক থেকে প্রস্তাবের আশা করছেন তারা। কিন্তু শম্পা ভয়ে আপনাকেও কিছু বলছিল না, আমাকেও দেখা করে কিছু বলতে দিচ্ছিল না। কেবলই বলে বি. এ. পাস করার আগে কিছু হবে না।
বিভাবতী খানিক হাঁ করে চেয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে। প্রথমে ঘাবড়ে গেহল, নইলে মুখে বোল আছে।
শম্পা! হঠাৎ দরজার দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন তিনি।
শুকনো নতমুখে শম্পা দোরগোড়ায় দেখা দিল।
ঘরে কি আছে দেখ, সুনীলকে খেতে দে। আর শোন, আমি এক্ষুনি ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি যাচ্ছি।
সুনীল তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল, খাওয়া পরে হবে, আপনি চলুন না—
তুমি বোসো।
এই হুকুমের ধরণই আলাদা। সুনীল তাড়াতাড়ি বসে বাঁচল। আর ব্যস্তসমস্ত শম্পা ছুটল রান্নাঘরের দিকে। আশায় আনন্দে থরথর করে কাঁপছে সে।
বিভাবতী লাল বাড়ি থেকে ফিরলেন যখন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সুনীলই পৌঁছে। দিয়ে গেল। শম্পা উদগ্রীব হয়েই ছিল সারাক্ষণ। কিন্তু মায়ের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ভালো খবর কি খারাপ খবর। খারাপ খবর হবার তো কোন কারণ নেই, তবু ত্রাস যায় না। মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে মা কিছু করে আসতে পারে বলেই ধারণা নেই তার।
তোর বাবাকে ঠিকমত ওষুধ খাইয়েছিস?