চলনদারকেও অসুবিধেয় ফেললেন না তিনি। হাওড়া স্টেশনে নেমে নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসে তাকে বিদায় দিলেন। এ তো আর ব্যাণ্ডেল নয় যে পথ-ঘাটের হদিস পাবেন না তিনি! কোথায় নামতে হবে জানাই আছে। আর কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা করেও অভ্যেস আছে, এক মাছ-তরকারির বাজার ছাড়া সব কেনা-কাটাই তো নিজের হাতে করেন।
.
শম্পা বাড়ি ছিল না। কলেজ থেকে ফিরেই বেরিয়েছিল কোথায়। ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে। বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের সঙ্গে অর্থাৎ শ্যামলের সঙ্গে দেখা। ছোড়দির সাড়া পেয়েই ও হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে গলা খাটো করে বলল, এতক্ষণ ছিলি কোথায়? মা চলে এসেছে–আর এসে পর্যন্ত কি কাণ্ড, কাছে যেতে ভয় করছে। প্রথমেই বাবাকে খামোকা যাচ্ছেতাই বকাবকি করে নিল খানিকক্ষণ, তারপর আমাকে, আর একটু আগে ঝি-টাকে—
শোনামাত্র শম্পার খুশি মুখ থেকে প্রাণটুকুও যেন উড়ে গেল। সত্রাসে ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল খানিক, বলল, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা ছিল না…
শ্যামল বলল, সেই জন্যেই তো আমিও হাঁ, তোকে বলে চুপি চুপি আজ একটা ছটার শো মারব ভেবেছিলাম-ভাগ্যিস যাই নি!
ভয়ে ভয়ে শম্পা জিজ্ঞেস করল, আমার কথা কিছু বলেছে?
না, তুই বাড়ি নেই–রাগের মাথায় এখনো খেয়ালই করে নি হয়তো। ব্যাণ্ডেলেই কিছু একটা হয়েছে বোধ হয়, বড়দির অসুখটাই বেড়ে গেল কিনা বুঝছি না।
শম্পা বলল, অসুখ বেড়ে থাকলে মা চলে আসবে কেন?
শ্যামল বলল, অই তো–তবু সেখানেই নির্ঘাৎ কিছু হয়েছে, নইলে ফিরেই এই মূর্তি কেন? মা এখন বাবার ঘরে, তুই চুপি চুপি ঘরে গিয়ে ওই স্টাইলের শাড়ি পরা বদলে ঠিকঠাক হয়ে নে তো যা–
পাংশু মুখে পা টিপে শম্পা বারান্দা ধরে এগলো। এক সারিতে ছোট বড় তিনখানা। ঘর। প্রথম খুপরি ঘরটা শ্যামলের, বোনেদের বিয়ে হবার পর দ্বিতীয় ঘরটাতে এখন। শম্পা একাই থাকে। ঘরের আলো নেবানো। তার পরের ঘরটা বাবা-মায়ের–সে ঘরে আলো জ্বলছে।
নিজের ঘরের দোরগোড়ায় এসে শম্পা দাঁড়াল একটু, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে শুনতে চেষ্টা করল, বাপ-মায়ের ঘরের কোন কথা কানে আসে কিনা।
পরের মুহূর্তে যা ঘটে গেল, অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল শম্পা। আচমকা চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে কে তাকে তার অন্ধকার ঘরের মধ্যে এনে ফেলল। হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল, কোন রকমে টাল সামলে আবার আর্তনাদ করে ওঠার উপক্রম।
চুপ!
মায়ের চাপা গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করার শব্দ। তারপর ঘরের আলো জ্বলে উঠল।
সামনে মা দাঁড়িয়ে। দুচোখ ধকধক করে জ্বলছে। বি, এ, পড়া মেয়েকে চুলের মুঠি ধরে এভাবে ধরে টেনে আনা কিছুই নয়, মায়ের এ-মূর্তি দেখে শম্পা থরথর করে কেঁপে উঠল।
বিভাবতী দেখছেন মেয়েকে, ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখের আগুনে ঝলসে দিচ্ছেন। সমস্ত মুখ লাল, ক্রুদ্ধ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছেন অল্প অল্প।
ওই ছেলেটা কে?
হিসহিস শব্দটা যেন এক ঝলক গলানো শিসের মতো কানে ঢুকল শম্পার। মাথাটা ঘুরে গেছে, চোখে লাল নীল সবুজ হলদে দেখছে।
তোকে আজ খুন করে ফেলব! রেস্টুরেন্টে বসে কার সঙ্গে ঢলাঢলি করছিলি আর গিলছিলি?
মা! ত্রাসে মায়ের হাত কিংবা পা ধরার জন্য এগিয়ে আসছিল শম্পা।
আবার এক ধাক্কা খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে মাটিতে বসে পড়ল। বিভাবতী সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরেই তাকে হিড়হিড় করে টেনে তুলে ধাক্কা দিয়ে চৌকিতে বসিয়ে দিলেন–তোকে আমি মেরেই ফেলব আজ, বটি দিয়ে কাটব, শিক পুড়িয়ে তোর পিঠে ছ্যাকা দেব-বল শিগগীর ছেলেটা কে?
মা! বলছি মা, তুমি একটু স্থির হয়ে বোসো, তোমার পায়ে পড়ি মা
খবরদার! তুই আমাকে মা ডাকবি না। তিন দিনের জন্য গেছি, তার মধ্যে এই চরিত্র তোর? গলায় দড়ি জোটে নাকাল আমিই তোকে দড়ি এনে দেব–ভালো। চাস তো কে ছেলেটা আগে বল শিগগীর!
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শম্পা বলল, ওই তিনতলা লাল বাড়ির
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন কোন তিনতলা লাল বাড়ির।–ওই সামনের রাস্তার মুখের লাল বাড়ির?
শম্পা কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ল–তাই।
ঠিক এই জায়গায় বাইরে শৈলেশ চাটুজ্জের কোমল ডাক ভেসে এলো।
এ ঘরের দরজা বন্ধ কেন? শম্পা, তোর মা কোথায় রে, আমাকে ওষুধ দেবে না?
যাচ্ছি! জানালার দিকে চেয়ে তপ্ত একটা ঝাঁপটা মারলেন বিভাবতী, তারপর মেয়ের দিকে ফিরে দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, বসে থাক, এখান থেকে নড়বি তো আস্ত রাখব না।
দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
আতঙ্কিত শম্পা ধরেই নিয়েছে বাবাকে ওষুধ খাইয়েই মা এক্ষুনি ফিরবে। কিন্তু তিনি ফিরলেন না। রাতে খাবার সময় হলো, তখন পর্যন্ত না। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে তাকে, থমথমে মুখ। একবার দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলেন, খেতে আয়!
ভয়ে ত্রাসে মুখ-হাত পর্যন্ত ধোয়া হয় নি তখনো। বসেছিল আর প্রমাদ গুনছিল। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে এসে খেতে বসল। যে যার নিঃশব্দে খেয়ে উঠল। ছোড়দির মুখ দেখে শ্যামল বুঝে নিয়েছে সঙ্কটজনকই কিছু ঘটেছে। মা মাঝে মাঝে ছোড়দির দিকে যেভাবে চোখ বুলোচ্ছে তাতে তারই ভয় ধরে গেছে। আর ছোড়দিটা যেন বেঁচে নেই, কলের পুতুলের মতো হাত নড়ছে আর এক-একবার মুখে উঠছে।
খাওয়ার পাট চুকল।