একটু বাদে নন্দ ঘোষ বেরিয়ে খাবার নিয়ে এলো দুজনের জন্য। প্রতি শনিবারে দোকান বন্ধ হলে কম করে ঘণ্টা দুই ধরে দোকানের জিনিসপত্র নতুন করে সাজায় কাজললতা, গোছগাছ করে। নন্দ ঘোষ ততক্ষণ অপেক্ষা করে আর দেখে চেয়ে চেয়ে। তারপর একসঙ্গে খায় দুজনে বসে।
খাওয়া শেষ হল। কাউন্টারের ওধারে ছোট টুলে মুখোমুখি বসে একসঙ্গে গোটাপাঁচেক সমস্যার ফিরিস্তি দিল কাজললতা। নিজেই আবার সমাধানের রাস্তা খুঁজতে লাগল। কারণ নন্দ ঘোষ বেশির ভাগই চুপ। চেয়ে আছে। দৃষ্টিটা ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
কাজললতার হঠাৎ খেয়াল হল, তার একখানা হাত লোকটার হাতের মুঠোয় চলে গেছে কখন। ওদিকে সন্ধ্যাও কখন পার হয়ে গেছে।
কাজললতার দুচোখ তার মুখের ওপর থমকালো।
তুমি অত বড় সিঁদুরের টিপ পরো কেন? অস্বস্তি বোধ করে বলেই বোধহয় কথা কটা বেরুল নন্দ ঘোষের মুখ দিয়ে।
কাজললতা জিজ্ঞাসা করল, ছোট করতে হবে?
নল ঘোষের মুখের দিকে চেয়ে আছে শুধু। জবাব দিয়ে উঠতে পারল না। করলে খদ্দেরদের কাছে দোকানের বৈচিত্র্য নষ্ট হবে কিনা ভেবে পেল না।
চেয়ে আছে কাজললতাও।
সচকিত হয়ে হঠাৎ বিষম চমকে উঠল দুজনেই। কাউন্টারের ওধারে দাঁড়িয়ে আছে কে।
কে- কাজললতা চিনল না। একটি বউ…কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, কোলে একটি ফুটফুটে ছেলে। কিন্তু এ কি দেখছে কাজললতা? এরকম আর কবে দেখেছিল?
..মৃত্যুর আঘাতে স্তব্ধ পশুর সেই শেষ অব্যক্ত যাতনা আর সেই অব্যক্ত ক্রুর হিংসা যেন গলে গলে পড়ছে। এই দুই চোখেও। ঠিক যেমন দেখেছিল রাধাকান্তর চোখে।
বিমূঢ় মুখে নন্দ ঘোষের দিকে ফিরতেই কাজললতা বুঝতে পেরেছে ছেলে কোলে বউটি কে। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাক পাথর যেন কাজললতা।
সামলে নিয়ে নন্দ ঘোষ রূঢ় কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল প্রায়, তুমি এখানে। কেন? ও-যাও বলছি, এখুনি যাও এখান থেকে!
কেলের ছেলেটা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। বউটির দুই চোখের গলিত ঘৃণা একটা কাপটা মারল নন্দ ঘোষের মুখের ওপর। তারপর সেই অব্যক্ত যাতনায় কাজললতার সর্বাঙ্গ আর একবার ঝলসে দিয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি চলে গেল সে।
নন্দ ঘোষ শুকনো গলায় জোর এনে আস্ফালন করল, বাড়ি গিয়ে আমি দেখাচ্ছি। ওকে মজা! নিশ্চয় চাকরি গেছে বলে দোকানের ওই নচ্ছার মেয়েটা গিয়ে লাগিয়েছে!
কাজললতা কাঠ।
.
পরদিন থেকে কেউ আর তাকে দেখেনি। আবারও সার জেনেছে কাজললতা, তৃতীয় মানুষ এলে দুজনার ঘর টেঁকে না।
বিবেচনা সাপেক্ষ
পড়া শেষ হতে সকলেই ওরা চুপচাপ বসে রইল খানিক। শ্রোতাদের মধ্যে দুজন বেশ নামী সাহিত্যিক। বাদবাকি সকলে মোটামুটি নামী। গল্পটা নিয়ে মনে মনে সকলেরই একটু বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে ভেবে আমি মনে মনে খুশি।
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নামী দুজনের একজন জিজ্ঞাসা করলেন, তা তোমার ইচ্ছেটা কি, নতুন লেখকের এই গল্প ছাপতে চাও?
আমি মাথা নাড়লাম, সেই রকমই ইচ্ছে বটে।
একটু ভেবে তিনি মন্তব্যসহ আবার প্রশ্ন করলেন, মাথা খাঁটিয়ে মোটামুটি মন্দ দাঁড় করায়নি, কিন্তু তোমার অতবড় কাগজে ছাপার মত স্পার্ক কিছু দেখছ কি?
আমি সায় দিলুম, খুব অবাক করার বা মুগ্ধ করার মত কিছু দেখছি না বটে। নতুন লেখকের গল্প নিয়ে সঠিক আলোচনা এরপর গড়গড়িয়ে বিস্তৃত হতে থাকল।
মোটামুটি নামীদের একজন বলল, লেখকের ভাষা বেশ সহজ তরতরে সেটা ঠিক, এজন্যেই আপনার ভালো লেগেছে বোধহয়। কিন্তু গল্পটাতে ভাবের চাপা বাঁধুনি কম, তাছাড়া ঠিক ছোট গল্পের ছকে এটাকে ফেলা যায় না–অনেকটা রিপোর্টিংয়ের মত লাগছে।
প্রতিবাদের সুরে আর একজন সমর্থনই করল তাকে। বলল, নতুন লেখকের কাছে তুমি তার বেশি আশা করো কি করে?
হাসিমুখে তৃতীয় তরুণ শ্রোতা গল্পটার বুকে অনায়াসে একটা ধারালো ছুরি চালিয়ে দেবার মত করে মন্তব্য করল, কিন্তু আগাগোড়াই উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগাণ্ডা ধরনের না? গল্পের রসের উপর দিয়ে উদ্দেশ্যটা এ রকম সাদাসাপটাভাবে উপচে উঠবে কেন?
আসরের দুনম্বর নামী সাহিত্যিক মুখ খুললেন এবারে, মাথা নেড়ে বললেন, সেদিক থেকে গল্পটা তো মার খেয়েইছে, তা ছাড়াও অনেক জায়গায় একটু আনরিয়েল হয়েছে। কোর্টে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ়া বিভাবতীর জবাব আর বিচারুকের চাপা উচ্ছ্বাসের দিকটাই ভাবো না–অবাস্তব মনে হয় না?
আমি দ্বিধান্বিত মুখে জবাব দিলাম, কিন্তু লেখক তো বলছে গল্পটা সত্যি ঘটনার ছায়া নিয়ে লেখা।
মোটামুটি নামীদের একজন সপ্রতিভ মুখে বলে উঠল, সত্যের থেকে ছায়াটা যে একটু বেশিই বড় হয়ে গেছে!
সকলে হাসল একপ্রস্থ।
একনম্বর নামী লেখক এবারে দুনম্বর নামী লেখকের সমালোচনার ওপর মন্তব্য চাপালেন।-আনরিয়েলই যদি বলো তো সব থেকে বেশি অস্বাভাবিক ব্যাপার মেয়ে বিয়ের রাতে মহিলাটির তার স্বামীকে ওভাবে মোটরে চাপিয়ে ব্যাণ্ডেলে চালান করা।
ওরকম ভ্যাবলাকান্ত স্বামী গল্প-উপন্যাসেই যা দুচারটে দেখা যায়।
মোটামুটিদের একজন সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল বারকয়েক–আমি ঠিক এই পয়েন্টটাই বলতে যাচ্ছিলাম দাদা, বিভাবতীকে সধবা রাখার দরকার কি? বিধবা করে দিলেই তো ওদিকের প্রবলেম মিটে যায়।
গল্পের সধবাকে কলমের খোঁচায় অনায়াসে বিধবা করে দেওয়া যেতে পারে, আর তাতে মেয়ে-বিয়ের রাতে ভ্যাবলাকান্ত স্বামীকে হারানোর সমস্যাও মেটে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। গল্পের মুখ রক্ষার খাতিরে এটুকু সংস্কার গহিত কেউ বলবে না। গল্প লিখতে বসে নিজেই কত সময় কুমারী মেয়েকেই বিধবা করেছি আর বিধবাকে শেষ পর্যন্ত কুমারী করে দিয়েছি ঠিক নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে চুপ করেই রইলাম।