ছেলেটাকে একেবারে হাবাই ভাবলেন কিনা বড় সাহেব, বাবা দিনকতক সেই অস্বস্তি ভোগ করেছেন। তারপর একদিন দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ঢুকেছেন। কোম্পানীর চিফ অ্যাকাউনটেন্ট বলে কোনো পোস্ট ছিল না এতদিন–এখন হল। জনাকতক জুনিয়র আর সিনিয়র অ্যাকাউনটেন্ট কোম্পানীর কাজ চালাতেন। চ্যাটার্জী মেটালস-এর তিনিই প্রথম চীফ অ্যাকাউনটেন্ট-মাইনে তিনশ সত্তর থেকে এক লাফে পাঁচশ সত্তর।
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জীর সঙ্গে গৌরকিশোরের আবার দেখা হয়েছে মাস নয়েক বাদে। শোকের আর দুশ্চিন্তার তাপ নিয়ে গেছলেন বাবার শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে, আর কিছু না হোক, দুটো সহানুভূতির কথা শুনবেন আশা ছিল। কিন্তু শোকের তাপের সঙ্গে অবজ্ঞার তাপ নিয়ে ফিরেছেন।
বেয়ারার মুখে খবর পেয়ে কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী তাকে ঘরে ডেকেছিলেন অবশ্য। বসতে বলেননি। তার পরনে কাঁচা-কোঁচা, হাতে আসন, একগাল খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। মুখ তুলে একবার শুধু দেখেছিলেন তাঁকে, তারপর আবার ফাইলে মন দিয়েছিলেন। বাবার আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেননি। সন্তর্পণে শ্রাদ্ধ-পত্র তার সামনে টেবিলে রাখতে মুখ না তুলেই মাথা নেড়ে শুধু বলেছেন, ঠিক আছে
বাইরে এসে গৌরকিশোরের কান্না পাচ্ছিল পাঁচটি ভাই বোন তারা, তিনিই বড়। বাবা চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে শোকের থেকেও তিনি চোখে অন্ধকার দেখেছেন বেশি। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের ঘর থেকে বেরুতে সেই অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে উঠেছিল।
অবাক একটু হয়েছিলেন ঠিক দুদিন বাদে। নতুন চিফ অ্যাকাউনটেন্ট নিজে এসেছিলেন বাবার সমস্ত পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে মিটিয়ে দিতে। তাছাড়া বাড়তি এক হাজার টাকা দিয়েছেন বড় সাহেবের নাম করে–বাবার শ্রাদ্ধের কাজের বাবদ। হাতে টাকা নিয়েও গৌরকিশোর ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না।
আর হতচকিত হয়েছেন বাবার কাজের দিনে। ভাঙা বাড়ির দরজায় মস্ত ঝকঝকে গাড়িটা থামতেও ঠাওর করে উঠতে পারেননি কে এলেন। বিমূঢ় মুখে ছুটে এসে তারপর গাড়ির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছেন গৌরকিশোর।
শ্রাদ্ধবাসরে কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী মিনিট পাঁচেক বসেছিলেন। যাবার আগে বলে গেছেন, কাজকর্ম চুকে গেলে অফিসে একবার দেখা কোরো।
দেখা করেছেন। এই দিন বড় সাহেব তাকে বসতে বলেছেন। আলাপ করেছেন। বাড়িতে কে আছে না আছে খোঁজ নিয়েছেন। চিন্তা করেছেন একটু। তারপর বলেছেন, মন দিয়ে পড়াশুনা করে যাও–তোমার বাবা খুব বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিলেন, তুমি এম, এ পাশ না করা পর্যন্ত কোম্পানী তাই তোমার মায়ের নামে মাসে দুশ টাকা করে দেবে ঠিক করেছে।
গৌরকিশোরের চোখে জল আসার উপক্রম। অল্প হেসে বড় সাহেব বলেছেন, আর একটা কথা, এখন থেকেই একটু স্মার্ট হতে চেষ্টা করো–এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না। আচ্ছা এসো, উইশ ইউ ভেরি ভেরি গুড লাক!
গোরকিশোর আবার দেখা করতে এসেছেন এক বছর পাঁচ মাস বাদে। এম,– এ পরীক্ষার ফল বেরুবার পর।
তাকে দেখামাত্র উৎফুল্ল মুখে বড় সাহেব হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ এবারের সুখবরটা সেদিনের সকালের কাগজে দেখেছেন তিনি। বারকয়েক খুশি জ্ঞাপন করে টেবিলের ব্রোতাম টিপে বেয়ারার তলব করেছেন। দুই ছেলে, অর্থাৎ বড় আর মেজ চ্যাটার্জী সাবকে একসঙ্গে সেলাম দিতে বলেছেন।
ছেলেরা আসতে হাসিমুখে গৌরকিশোরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। –আনন্দকিশোরের ছেলে গৌরকিশোর, স্কুল-ফাইনালে শুধু পরীক্ষা খারাপ করে সেকেণ্ড হয়ে বসেছিল–তারপর আই, এসসি-তে ফার্স্ট, বি, এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, আর এবার এম, এ-তে ফাস্ট ক্লাস ফার্স্ট।
পরিচয়-পর্বে শুধু বড় সাহেব নয়, গৌরকিশোরের সৌজন্যসূচক স্মার্টনেসের অভাব ছেলেরাও লক্ষ্য করলেন। কোম্পানীতে বিলেত-ফেরত এনজিনিয়ার আছেন চারজন, সেখানে এম, এ-র এই কৃতিত্ব বাবার কাছে এমন বড় ব্যাপার হল কি করে ছেলেরা বুঝলেন না!
বড় সাহেব বললেন, তোমরা দুজনেই ওকে ভালো করে কাজ-কর্ম শেখাবে। …ওর ডেসিগনেশন কি হবে? বড় ছেলের দিকে ফিরলেন, এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দাও, পরে দেখা যাবে।
সেক্রেটারী বড় ছেলে।
হাসিমুখে বড় সাহেব গৌরকিশোরের দিকে ফিরলেন, এঁদের সঙ্গে যাও, খুব বুঝে-শুনে ভালো করে কাজ-কর্ম করবে।
একটানা তিন বছর চ্যাটার্জী মেটাল-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী হয়েই ছিলেন গৌরকিশোর। কাজে সুনাম কিছু হয়েছে, কিন্তু সেটা চটকদার সুনাম নয়। দায়িত্বের কাজ দিলে সেটা তার দ্বারা সুসম্পন্ন হবে কিনা বোঝা ভার, অথচ শেষ পর্যন্ত হয় ঠিকই। ফলে কাজ যাঁরা দেন তারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না সর্বদা। বড় সাহেব ছেলেদের জিজ্ঞাসা করেন, কেমন?
তারা বলেন, ভালই, তবে আনস্মার্ট।
কৃষ্টকমল চ্যাটার্জী মাথা নাড়েন, আনস্মার্ট ঠিক নয়…ডিফরেন্ট টাইপ।
তাঁর মতলব বোঝা গেছে তিন বছর বাদে-বছর দুয়েকের চেষ্টায় ছোট মেয়ে লোটি অন্যথায় লতা চ্যাটার্জী যখন টেনেটুনে বি, এ পাশ করে উঠলেন।
কমল চ্যাটার্জীর তিন ছেলে, ছোট ছেলে গৌরকিশোরের থেকে বছর দুয়েকের ছোট, আর লতার থেকে বছর তিনেকের বড়। ছোট ছেলে সক্রিয়ভাবে চ্যাটার্জী মেটাল-এ ঢোকেননি তখনো। ওদিকে বড় দুই ছেলের পরে দুটি মেয়ে ছিল, হর ছোট ছেলের পর লোটি–সর্বকনিষ্ঠা। বাপের বেশি বয়সের মেয়ে, তাই তার আদরও বেশি। বেশি আদরের আরো একটু কারণ আছে।