কিন্তু কাজললতা কি দেখেছিল সেই চোখে? আর সঙ্গে সঙ্গে কি মনে পড়েছিল তার?
মৃত্যুর আঘাতে স্তব্ধ পশুর শেষ অব্যক্ত যাতনা আর অব্যক্ত হিংসা যেন গলে গলে পড়তে দেখেছে ওই দুটো চোখে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে সেই জ্যোতিষীর কথা-খুন করে ফাঁসীকাঠে ঝোলার কথা।
কেমন করে দোকান থেকে তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কাজললতা জানে না। আর কি করবে এখন, তাও জানে না।
চমকে ফিরল।…বটুক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছে।
তারপর…
হ্যাঁ, তারপর দূরে অনেক দূরে পালিয়ে আসার পর, পরপুরুষের লোলুপ হিংস্র বীভৎসতা, আর নির্দয় নগ্ন অত্যাচারই দেখেছে সে। গা-ঢাকা দিয়ে থাকা দরকার বুঝিয়ে বটুক পাকিস্তান বর্ডারে এনে ফেলেছিল তাকে। সময় আর সুযোগ বুঝে তাদের ফেরার কথা।
কিন্তু ফিরেছিল কাজললতা একাই। খুব সঙ্গোপনে। বটুকের চোখে ধূলো দিয়ে। …বটুকের নেশা কেটেছে। কুৎসিতদর্শন লুঙ্গিপরা লোকের সঙ্গে গোপনে সলাপরামর্শ করতে দেখেছিল তাকে কাজললতা। তার মতলব বুঝেছিল। সেই দিনই পালিয়েছিল।
সাত দিন হয় কলকাতায় ফিরেছে। তাকে আশ্রয় দিয়েছে প্রায় অন্ধ এক বুড়ী। ট্রেনে যোগাযোগ তার সঙ্গে। সে তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, কলকাতায় কোনো বাড়িতে কাজ জুটিয়ে দেবে একটা। বুড়ীর কোথাও কেউ নেই তেমন–বোনপোর কাছে এসেছিল। কলকাতায় দুতিনটে বস্তি-ঘর ভাড়া খাটায় সে।
কলকাতায় এসে কাজললতা জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ কপালে পরতে শুরু করেছে। শুধু পুরুষের কবল থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে, তাদের কৌতূহলের তাড়না থেকে নিজেকে বাঁচানোর দায়ে। কপালের এই জ্বলজ্বলে সিঁদুর একটা জোরালো নিষেধের কাজ করছে শুধু। সত্যমিথ্যেয় বুড়ীমাকে কি বুঝিয়েছে সে ভালো মনে নেই। কপালে অমন টকটকে সিঁদুর দেখে সে বলেছিল, আহা, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, বেঁচে থাক মা। এই সিঁদুরের টানেই মরদটা একদিন ফিরে আসবে দেখিস।
দিনে দিনে খুশি উপচে উঠছে নন্দ ঘোষের। সে যে এমন একজনকে দোকানে। লাগিয়েছে, ভাবতেও পারেনি। দোকানটাকে নিজের বলে ভাবতে পারে বটে মেয়েটা। সকালে সকলের আগে এসে নিজের হাতে ঝটপাট দেয়, তারপর খুঁটিনাটি যাবতীয় কিছু ঝেড়ে মুছে তকতকে করে তোলে।
অন্য মেয়েদের কারো গাফিলতি দেখলে সত্যি সত্যি রেগে যায়, বকাবকিও করে। কাউকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেও যেন তার চোখ টাটায়।
চারটে মাস না যেতে দোকানের আসল মালিক যে কে, এই ভুল হবার দাখিল অন্য কর্মচারী আর কর্মচারীণীদের। তাছাড়া নন্দ ঘোষকে সে পরামর্শও দেয়, এই করুন, এইসব জিনিস দোকানে এনে রাখুন। নন্দ ঘোষ তার প্ল্যান কাজ করে। দেখেছে, লাভ বই লোকসান হচ্ছে না। দোকানের এতটুকু ভালোর জন্যে এত উদবেগ। আর এমন উদ্দীপনা দেখে নন্দ ঘোষ যথার্থ অবাক হয়েছে এক এক সময়। পরীক্ষা করার জন্য ক্যাশের ভারও ছেড়ে দিয়ে দেখেছে এক-একদিন। দিয়েছে বটে, কিন্তু চোখ ঠিকই রয়েছে। একটা নয়াপয়সাও গরমিল হয়নি। নিজের জিনিস নিজের চুরি করার যেমন কথা ওঠে না, এ যেন তেমনি। ওদিকে খদ্দেরও বাড়ছেই।
তিন মাসের মধ্যেই নন্দ ঘোষের ভালো লাগতে শুরু করেছে। এই ভালো লাগাটা দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। কাজললতা তা ভালো করেই টের পেল। কিন্তু কিছু যায় আসে না যেন। কাজললতা শুধু এই দোকানটাকেই বড় করে তুলতে চায় আর সব কিছু ভুলতে চায়। দিনকে-দিন এই শুধু এক নেশার মত পেয়ে বসছে তাকে। লোকটা দুর্বল হলে যদি তার কর্তৃত্ব বাড়ে, আর আরো বেশি নিজের বলে ভাবতে পারে দোকানাটাকে–তার একটুও আপত্তি নেই। দোকান বড় করে তুলে কাজললতা যেন অদৃশ্য কারো ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে আর প্রায়শ্চিত্ত করছে।…আর পরপুরুষকে প্রশ্রয় দেওয়া? এখনো কপালের সিঁদুর তেমন করে লোকটাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি বটে, কিন্তু পর বলে সত্যিই কিছু আছে নাকি এখনো?
কাজললতা শুধু দোকানটাকে আকাশছোঁয়া বড় করে তুলতে চায়, আর কিছুই চায় না। একটু প্রশ্রয় না পেলে লোকটা সে সুযোগ দেবেই বা কেন তাকে? এক একসময় চমকে ওঠে কাজললতা, তার কি মাথাখারাপ হল? নইলে মালিকের আসনের ওই লোকটাকেসুষ্ঠু সময় সময় রাধাকান্ত বলে ভাবতে চেষ্টা করে কেন? কেন ভাবতে ইচ্ছে করে, যা ঘটে গেছে তার সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়?
ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে নন্দ ঘোষ। দোকানের উন্নতি প্রসঙ্গে আলোচনার হলে, দোকানের নানা সমস্যা নিয়ে আলাপের ছলে। এই আলাপ চলে দোকানে যখন আর তৃতীয় কেউ থাকে না, তখন। দোকান বন্ধ হবার পরেও দোকান নিয়ে মাথা ঘামায় দুজনে বসে।
নন্দ ঘোষের মাথা গরম হতে থাকে, হৃৎপিণ্ড লাফালাফি করতে থাকে, চোখের দৃষ্টি বদলাতে থাকে।
সেদিন শুক্রবার। একটা মেয়ের চাকরি চলে গেল। ঠারেঠোরে মেয়েগুলো প্রায়ই হাসাহাসি করত। সেই মেয়েটা সেদিন মুখে মুখে তর্কই করল কাজলল তার সঙ্গে। বলল, তুমি দোকানের কে যে কথায় কথায় চোখ রাঙাও?
কে সেটা তক্ষুনি তাকে বুঝিয়ে দিল নন্দ ঘোষ। পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে পত্রপাঠ বিদায় করল তাকে।
পরদিন শনিবার।
তিনটেয় দোকান বন্ধ। বন্ধ হল। কাজললতা আর নন্দ ঘোষ ছাড়া আর সকলে চলে গেল। লোহার গেট প্রায় সবটাই টেনে দেওয়া হল, ভারী কালো পর্দা পড়ল।