সেই সাইনবোর্ড শেষ হতে চোখে পলক পড়ে না কাজললতার। মাঝখানে বড় বড় লাল আগুনের হরপে দোকানের নাম–আর দুমাথায় দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে একজন মেয়ে আর একজন পুরুষ। মুচকি হেসে রাধাকান্ত মেয়েটাকে দেখিয়ে বলেছিল, তোমার মুখের আদল এনে দিলাম।
শোনার পর কাজললতার মনে হচ্ছিল সেই রকমই যেন। খুশিতে আনন্দে তাগিদ দিয়েছিল, ওই লোকটার মুখও বদলাও। রাধাকান্ত বলেছে, দোকানে কেউ ঢুকবে না তাহলে!
দোকান হয়েছে। স্টেশনারি আর ছোটখাট হোসিয়ারী মিলিয়ে একসঙ্গে দোকান। এই সঙ্গে নৈমিত্তিক ঘরকন্নার সামগ্রীও কিছু রেখেছে। দোকান করতে বসে রাধাকান্তর নেশা চেপে গেল যেন। কম করে আরো হাজার দেড়েক টাকা চাই চাই-ই। এবার স্ত্রীকেই পরামর্শ দিল, টাকাটা বটুকের কাছ থেকে ধার পাবার চেষ্টা করতে। নিজে চাইলে দেবে কিনা সন্দেহ, কিন্তু কাজললতা চাইলে নিরাশ করবে না হয়ত। যেমন করে হোক যোগাড় করে দেবে।
দিল। ধার করেই এনে দিন নাকি। বলা মাত্র এত টাকা ধার পায় যে, তার ওপর কাজললতার একটু শ্রদ্ধা বাড়াও স্বাভাবিক। দোকান চলতে লাগল। কাজললতাও যখন দোকানে কাজ করার প্রস্তাব দিল, রাধাকান্তর খুশি ধরে না। লোক তাহলে আর একজনের বেশি রাখতেই হবে না–আর স্বামী-স্ত্রী দুজনে দোকান চালাচ্ছে, এই বৈচিত্র্য যে লোক টানবে তাতে তার একটুও সন্দেহ ছিল না।
ছটা মাস এই এক নেশার মধ্যেই কেটে গেল। কিন্তু টাকায় টান পড়ছেই। দোকানের টাকা ভেঙেই খেতে হচ্ছে। দোকান বড় করতে হলে আরো টাকা চাই। ওদিকে বটুকের কাছ থেকে আর টাকাপয়সা দূরের কথা, আভাসে ইঙ্গিতে আগের টাকাই ফেরত চাইছে সে। যার কাছ থেকে টাকা এনে দিয়েছিল সে তাগিদ দিচ্ছে।
ইদানীং বটুককে একটু খাতির করেই চলছে রাধাকান্ত। কাজললতাও। লোকটা উপকার তো কম করে না। ফঁক পেলে দোকানে এসে দাঁড়ায়, সাহায্য করে। সেই লোক টাকার কথা বলতে রাধাকান্ত বিপদ গনল। আবারও স্ত্রীকেই পরামর্শ দিল, ওকে একটু বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে।
বোঝাতে গিয়ে তাকে চোখই রাঙাল কাজললতা, এখন টাকা চাইছেন মানে! টাকা দেব কোত্থেকে? উল্টে আরো টাকার যোগাড় দেখুন। বটুক হেসেছে একগাল। বলেছে, তুমি বললে তাও পারি না এমন নয়!
এদিকে দোকান করার নেশা কাজললতার অন্তত কমে আসছিল একটু একটু করে। আর সেটা যে ঠাট্টা-ঠিসারায় কমিয়ে আনছিল বটুকই, সেটা তখন অন্তত মনে হয়নি। এই দোকান করার ফাঁকে লোকটা আপন মনের মত আরো অনেক কাছে এসে গেছে। রাধাকান্ত মাল সংগ্রহের কাজে বেরোয়, দোকান চালায় তখন বটুক আর কাজললতা। বটুক নিজের কাজ কামাই করে প্রায়ই! তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসি-আনন্দের মধ্যে দোকান চালাতে ভালই লাগে কাজললতার। ফাঁক পেলে বটুক সিনেমার মজার মজার গল্প শোনায় তাকে। বিশেষ করে আর্টিস্টদের গল্প। কাঁচা নোট কিভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে সেখানে, সেই গল্প। একস্ট্রা আর্টিস্টকে ইচ্ছে করলেই সে নাকি এখন দিন পিছু দশ টাকার জায়গায় কুড়ি টাকাও পাইয়ে দিতে পারে।
শুনে কাজললতার বুকের ভিতরে দোলা লাগে। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে।
এদিকে রাধাকান্তর ওপর টাকার চাপটা শিথিল করল না সে। অপর দিকে সমর বুঝে কাজললতাকে জানিয়ে রাখল, অবুঝ লোকটাকে বশে আনার জন্যেই তার এই কারসাজি। চাপে পড়ে কাজললতাকে একটু স্বাধীন হতে দিলে সে-ই কাড়ি কাড়ি টাক এনে দিতে পারে। স্বাধীন হতে দিলে! কথাটা কোথায় গিয়ে যে স্পর্শ করেছিল, কাজললতা জানে না। তার মনে হতে লাগল, বিয়ের পর থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে সে এক অবুঝ শাসনের শিকলে বাঁধা।
সেই থেকে মন্ত্রণা শুরু। বটুক আরো বেশি করে ধার শোধের চাপ দিলেও তার আপত্তি নেই। তাকে স্বাধীন হতে দিলে টাকা রোজগার করে সে তো এই দোকানেই ঢালবে–দোকান ফাঁপিয়ে তুলবে। তাছাড়া যে স্বাধীনতার স্বপ্ন সে দেখছে, তার কাছে। এই দোকানও একটা পিঞ্জরের মত।
তার এই স্বপ্নের ঘোরে কতখানি এগিয়ে এসেছিল বটুক, কাজললতা দেখেও দেখতে চায়নি। তার হাতে কাঁধে হাত রাখলে কাজললতার মুখ লাল হয়েছে। বটুক অমনি টিপ্পনী কেটেছে, থাক, আর ছবিতে নেমে কাজ নেই!
তারপর সেই একদিন…।
শনিবার। দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ হবে। রাধাকান্ত দেশে গিয়েছিল যদি আর কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারে। দেশে তখনো তার দখলে মজা পুকুর ছিল একটা। সেদিন ফিরতেও পারে, না-ও পারে। ফেরে যদি অনেক রাতে ফিরবে।
কিন্তু আসলে রাধাকান্ত যে কোথাও যায়নি, সেটা এরা কেউ জানত না। যথাসময়ে দোকানের লোহার দরজা টেনে দেওয়া হয়েছে। কালো ভারী ক্যানভাসের পরদাটাও। দুজনে ঘেঁষাঘেঁষি দুটো টুলে মুখোমুখি বসে তন্ময় হয়ে জল্পনা-কল্পনা করছে। কেমন। করে ঘরের অবুঝ লোকটাকে বোঝানো যায়? কি কৌশলে কাজললতা এটুকু স্বাধীনতা আদায় করতে পারে? তার একটা হাত বটুকের হাতের মুঠোয়। সন্ধ্যা কখন পেরিয়ে গেছে খেয়াল নেই।
কখন লোহার গেট সরেছে, কখন পুরু ভারী পরদাটা নড়েছে তারা টেরও পায়নি। পাবে কি করে, উঁচু কাউন্টারের ওধারে ওদিক ফিরে দুটো নিচু টুলে বসে দুজনে।
..তবু ষষ্ঠ চেতনা বলে আছে কিছু বোধহয়।
কাজললতা মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে একসময়।
পরক্ষণে ভয়ে বিবর্ণ পাণ্ডুর একেবারে। দুজনেই। কাউন্টারের ওধারে রাধাকান্ত দাঁড়িয়ে।