কিন্তু অবস্থার ফেরে স্নায়ুর উপর যত হাত পড়েছে মগজের উপর ততো নয়। স্টুডিওতে চাকরি করত। সিনসিনারি আঁকার কাজ। সে আর বটুক একসঙ্গেই কাজে কেছিল। ঠিক একসঙ্গে নয়– বটুক কদিন আগে ঢুকে তাকে ঢুকিয়েছিল। বটুকের মুখ ভালো চলে। গুছিয়ে কর্তাদের মনের মত ব্যবস্থাপত্র করা, সাজ-সরঞ্জাম জোগানো –এসব ব্যাপারে তার মাথা ভালো খেলত। কিছুকাল চাকরি করার পর কাঁচা টাকা রোজগারের পথটাও ভালই চিনেছিল। গণ্ডায় গণ্ডায় দশ টাকা রেটের এক্সট্রা আর্টিস্ট জুগিয়ে মাথা পিছু দুতিন টাকা বখরা আদায় করাটা আদৌ গর্হিত কাজ ভাবত না টুক! তাছাড়া পার্টির বিশ্বাসভাজন হয়ে খুচরো কেনা-কাটার ফাঁক দিয়েও মন্দ রোগার হত না তার। রোজগার যেমন করত, ওড়াতও তেমনি।
মনে মনে ওই লোকটাকেই রাধাকান্তর থেকে অনেক বেশি চৌকস ভাবত কাজললতা। বহু ব্যাপারে যোগ্য ভাবত। কিন্তু মনে মনে সে ভয়ই করত রাধাকান্তকে। এমন চণ্ডাল রাগ আর বুঝি দেখেনি। কত জায়গায় চাকরি করেছে ঠিক নেই। ওই মেজাজ নিয়ে কোথাও টিকে থাকে নি। স্টুডিওর চাকরিও কতবার যায়-যায় হয়েছিল, ঠিক নেই; প্রতিবারই ওই বটুকই বাঁচিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দোষটা পুরাপুরি রাধকান্তই ধরে নিয়েছিল কাজললতা। পয়সাওলা মালিকের যদি স্বভাবচরিত্রের বালাই না থাকে তো তার কি? আর ঈষং মত্ত অবস্থায় রাধাকান্তর আঁকা সিন অপছন্দ হওয়ার ফলে ঘরের বউকে টেনে একটা নিম্নস্তরের রসিকতা করে ফেলেই থাকে যদি তো সেইজন্য গায়ে ওরকম ফোস্কা পড়তে গেল কেন? আর রাগ হয়েছে বলে কি একেবারে মালিকের গলা টিপে ধরতে হবে?
কি হয়েছিল না হয়েছিল, বটুকের মুখে সবই শুনেছিল কাজললতা।
রাগ তো বলতে গেলে বিয়ের পর থেকে তারও।
কোন সাধ-আহ্লাদ মিটেছে তার? ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। অথচ কতরকম স্বপ্নই না, ছিল বিয়ের আগে। যে ঘরের মেয়ে কাজললতা, বিয়ের আগে তার রীতিমত প্রতিপত্তি ছিল বলা চলে পাঁচজনের কাছে। ওর মত সুন্দরী গোটা ব্যারাকের মধ্যে আর একজনও ছিল কিনা সন্দেহ। তার বাবা ছিল পুলিশ ব্যারাকের বাজার-সরকার। তাই স্বামীর থেকেও বটুকের কাজটা অনেক বেশি পছন্দ হত তার। তাছাড়া বটুক তার শিক্ষাদীক্ষার কদরও করতে জানত। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছিল কাজললতা। সেটা ওদের পরিবারে কম কথা নয়। এই লেখাপড়া আর এই চেহারা দেখেই পড়ন্ত মানীবংশের ছেলে হয়েও তাকে মনের আনন্দে নিজের ঘরে। নিয়ে গিয়ে তুলেছিল রাধাকান্ত। কিন্তু দুদিন না যেতে রূপের কদর, শিক্ষার কদর সব যেন ঘষা পয়সা।
তার উপর উঠতে বসতে শাসন। কাজললতার একটু সাজতেগুজতে ভাল লাগে, বিকেলে একটু রাস্তায় এসে দাঁড়াতে ভালো লাগে, আর সিনেমা দেখতে আর সিনেমার গল্প শুনতে কত যে ভালো লাগে তার ঠিক নেই। এই জন্যেই কি লোকটা কম। গঞ্জনা দিয়েছে তাকে?
এটে উঠতে পারে না শুধু বটুকের সঙ্গে। দুজনার ঝগড়া হয়, রাগারাগি হয়। কিন্তু বটুকের স্বভাব উল্টো বলে আবার ভাবও হয়। তাছাড়া উপকার তো কম করে না, ভাব না করে যাবে কোথায়? বটুক যখন সিনেমার গল্প করে বা কখনো জোর করে সিনেমায় নিয়ে যেতে চায়, অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও লোকটা বাধা দিতে পারে না।
চাকরি যাবার পর দিনে দিনে মেজাজের উন্নতি হতে লাগল রাধাকান্তর। মুখের দিকে তাকাতে ভয় করত কাজললতার। এদিকে দিন চলে না এমন অবস্থা। সেই দুঃসময়ে বটুক একটা মস্ত লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল কাজললতাকে। দিন পিছু দশটাকা হারে ছবিতে মুখ দেখাতে আপত্তি কি কাজললতার? কোথাও একটু কাঁদতে হবে, কোথাও একটু হাসতে হবে–কোথাও বা কিছুই করতে হবে না। সপ্রতিভভাবে একটু কাজ করতে পারলে উন্নতিও অবধারিত। দশটাকাটা বিশ পঁচিশ পঞ্চাশেও গিয়ে ঠেকতে পারে একদিন…বটুকেরই হাত, সে অনায়াসেই ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
রাধাকান্ত বাড়ি ছিল না। কাজললতা তার জন্য অপেক্ষা করছিল আর বাতাসে সাঁতার কাটছিল। তারপর রাধাকান্ত বাড়ি আসতেই বটুকের প্রস্তাবটা, আরো পবিত করে তার চোখের সামনে তুলে ধরেছিল।
রাধাকান্তর বুঝতে সময় লেগেছিল একটু। শেষ পর্যন্ত বুঝেছিল ঠিকই। সেই মুখের দিকে আর সেই চোখের দিকে চেয়ে কাজললতা সভয়ে পায়ে পায়ে সরে দাঁড়িয়েছিল। ভয়ে কাঠ সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বটুকের একদিনের গল্প মনে পড়ে গেল তার। কবে নাকি এক পরিচিত জ্যোতিষ দুই বন্ধুর হাত দেখে রাধাকান্তকে বলেছিল, রাগ-টাগগুলো সামলাও একটু, কবে না খুন করে ফাঁসীকাঠে ঝুলতে হয়!
..হঠাৎ মনে হল, সেই বীভৎস খুন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে লোকটার চোখে-মুখে। সেই কটা ত্রাসের মুহূর্ত কাজললতা ভুলবে না বোধহয়।
এর পরেই দিন ফেরাবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল রাধাকান্ত। দেশে কিছু জমিজমা ছিল, চেষ্টাচরিত্র করে তাই বিক্রি করে এলো। হাসিমুখতার হাতে সাড়ে তিন হাজার টাকা। কাজললতার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা।
রাধাকান্তর মন স্থির। চাকরি আর নয়, গোলামী আর নয়। বরাতজোরে ভালো ঘর পেল একটা। অবশ্য তার জন্য সেলামী গুনতে হল হাজার টাকার ওপর। তারপর দিনকতক নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজের হাতে সাইনবোর্ড না করতে বসল। দোকানের নাম শুনে তখন হেসে বাঁচেনি কাজললতা, দুজনার ঘর–মাথায় আসেও!