নন্দ ঘোষের মুখের ওপর তার ডাগর দুই চোখ আটকালেন্সবার। বলল, একটা চাকরির জন্য এসেছিলাম।…খুব দরকার। দেবেন?
না, এবারে আর নন্দ ঘোষ খুব বিস্মিত হয়নি। এই রকমই কিছু যেন মনে হয়েছিল তার। শোনামাত্র তার ঘাড় নাড়ার কথা। এযাবৎ আগে দুপাঁচটা মেয়ে তার কাছে চাকরির জন্য এসেছে। তাদের হাবভাব অবশ্য এরকম ছিল না। তারা এসেছে, সবিনয়ে চেষ্টা করেছে, তারপর চলে গেছে।
কিন্তু এর বেলায় নন্দ ঘোষ কেন যে মাথা নাড়তে পারল না তক্ষুণি জানে না। রমণীটির প্রতি গোড়াতেই তার চোখ পড়েছিল কেন, মুখের দিকে চেয়ে সেটাই আগে বুঝে নিতে চেষ্টা করল। সামনের চেয়ারটায় বসল এতক্ষণে। পকেট থেকে সস্তাদামের সিগারেট বার করে ধরালো। ব্যবসায়ীর তির্যক দৃষ্টি।
কাজললতা প্রতীক্ষা করবে। ব্যগ্র প্রত্যাশা। লোকটার একটা হাঁ বা নার ওপর যেন জীবনমরণ নির্ভর। এই ব্যাকুলতাই যে তার স্বপক্ষে কাজ করছে জানে না। শোনার অপেক্ষায় ফর্সা মুখ ঘেমে উঠেছে তার।
নন্দ ঘোষ ভাবছে যেন। ভাবছে ঠিকই, আর আড়ে আড়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে কেন চোখে পড়েছিল তার! …ওই অতবড় জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপটার জন্যই বোধহয়। মুখখানা বড়সড়, চওড়া, আর বেশ ফর্সা–তাই বোধহয় মানিয়েছে ভালো। তাকালেই দু চোখ আগে ওই সিঁদুরের ধাক্কা খায়।
–থাকা হয় কোথায়? আপনি তুমি বর্জন করে একটা নির্লিপ্ত প্রশ্ন নিক্ষেপ করল নন্দ ঘোষ।
এই কাছেই। …বস্তিবাড়ির একখানা ঘরে।
আর কে আছে?
কাজললতাকে চেষ্টা করতে হয়নি, মুখ দিয়ে আপনিই নির্গত হয়েছে।
–মা।
খুব মিথ্যে বলেনি কাজললতা, সাত দিনের চেনা ওই বুড়ী যদি মা না হয় তো মা আর কে?
স্বামী কোথায়? কি করে?
প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে ভেবে নিচ্ছে নন্দ ঘোষ। সম্মুখবর্তিনীর সচকিত বিবর্ণ মূর্তিটা তাই ভালো করে চোখে পড়েও পড়ল না নিলে কেমন হয় তাই ভাবছে সে। বৈচিত্র্যের দিকটা ভাবছে।…যে মেয়েগুলো আছে দোকানে, তারা অতি আধুনিকা। ওই কেমন হাওয়া আজকাল, নইলে তাকালে তো গা রি-রি করে নন্দ ঘোষের। কিন্তু খদ্দের। তো কত রকমেরই আছে, অনেকের হয়ত তারই মত গা রি-রি করে। সে-স্থলে এই বৈচিত্র্য দেখলে হয়ত চোখ জুড়োবে। মুখশ্রী বেশ কমনীয়, মিষ্টি, তার ওপর ওই জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ চোখ টানেই। তার যখন টেনেছে, কত খদ্দেরের টানবে ঠিক কি! গেরস্থঘরের মেয়ে-পুরুষদের ভালো যে লাগবে তাতে সন্দেহ নেই। আসল কথা, অতি আধুনিকা আর সিঁদুরপরা গেরস্থঘরের বউ–দু-রকমই কাজ করছে দোকানে–এই বৈচিত্র্যটাই বড় বলে মনে হতে লাগল নন্দ ঘোষের।
তার প্রশ্নের জবাবে বিড়বিড় করে কি বলল, নন্দ ঘোষের ঠিক যেন কানে ঢুকল না। মুখভাব একটু অন্যরকম দেখছে কেন, তাও বুঝল না। আবার জিজ্ঞাসা করল, স্বামী এখানে থাকে না?
কাজললতার মুখে ঘাম দেখা দিয়েছে আবার। মাথা নাড়ল– থাকে না।
নন্দ ঘোষের খটকা লাগল কেমন। স্বামীর কথায় মুখখানা অমন হয়ে গেল কেন? জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি বরাবরই এখানে থাকেন?
এবারও মাথা নাড়ল কাজললতা–অর্থাৎ এখানে থাকত না। কিন্তু মুখ বুজে থাকলে হবে না জানে। ঢোক গিলে মৃদু জবাব দিল, পাকিস্তানে থাকতুম, অদিন হল এসেছি।
অস্বস্তি…মিথ্যে বলার অস্বস্তি। কিন্তু খুব মিথ্যে নয় বোধহয়। পাকিস্তান বর্ডরেই তো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। আর কদিন থাকলে কি হত কে জানে!..অদিন হল এসেছে, তাও সত্যি।
নন্দ ঘোষ যেটুকু বুঝবার নিজের মত করে বুঝে নিল। যে জায়গা থেকে আসছে। বলল তাতেই যেন সব বোঝা হয়ে গেছে। সর্বস্ব খুইয়ে এ-রকম তো কতই আসছে। বুক বেঁধে যত বড় করেই সিঁদুরের টিপ পরুক, সত্যিকারের আশাভরসা যে কতটুকু তা এই মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
নাম কি?
কাজল…
মুখের ওপর লোকটার যাচাইয়ের দৃষ্টি এই যেন প্রথম অনুভব করল কাজললতা। সম্পূর্ণ নাম আর বলা হল না।
সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ এখানে, রবিবারে শুধু ছুটি–সুবিধে হবে?
কাজললতা তক্ষুনি মাথা নাড়ল, হবে। আরো বেশি সময় থাকতে হলেও আপত্তি ছিল না। থাকতে না পারাটাই যেন যাতনা।
মাইনে কত চাই?
যা দেবেন।
আশায় আনন্দে দুচোখ চকচক করছে কাজললতার। মাইনের কথা সে একবারও ভাবেনি। দুজনার ঘরে তার জায়গা হবে কি হবে না, সেটাই একমাত্র ভাবনা।
হবে মনে হয়…।
হল। পরদিন থেকেই তাকে আসতে বলে দিল নন্দ ঘোষ। তারও মনে মনে হিসেব কষা শেষ হয়েছে। চার-চারটে মেয়ে সে দোকানে রাখতে পারবে না। আগামী সপ্তাহে মাস শেষ হলে ওই কেতকী মেয়েটাকে বিদায় করবে। যেমন চেহারা তেমনি মুখের ওপর কটকট করে কথা বলে। কালই ছাড়িয়ে দেবে তাকে।
কাজললতা বাইরে এসে দাঁড়াল। কিন্তু পা নড়তে চায় না। বিকেলে যখন আসে, ভাগ্যের এই যোগাযোগ কল্পনাও করেনি। দূর থেকে খুব সঙ্গোপনে একবার চোখের দেখা দেখে যাবে বলে এসেছিল। কিন্তু সব ওলট-পালট হয়ে গেল কেমন। কাজললতা যেন এখনো নিঃসংশয় নয়, একটু আগের ওই অধ্যায়টা সত্যি কিনা। যা দেখেছে আর দেখে এলো, তাই ঠিক কিনা!
এ কার বদলে কাকে দেখল সে? দুজনার ঘরের আসল মালিক গেল কোথায়?
.
..দুটি জিনিসের সুনাম আর দুর্নাম ছিল রাধাকান্তর। তার মগজে বুদ্ধি ছিল আর স্নায়ুতে রাগ ছিল।
কিন্তু এ দুটি জিনিসের সহঅবস্থান রীতি নয়। একের প্রকোপে অন্যটিকে নিষ্প্রভ। মনে হত। মাথা যখন খেলত, উৎসাহ আর উদ্দীপনায় তখন কারো বড় দোষও চোখে পড়ত না। আবার স্নায়ু যখন চড়ত তখন মনগড়া ত্রুটি আবিষ্কার করে ত্রাসের কারণ হয়ে উঠতেও দেরি হত না।