নিজের অজ্ঞাতে আরো কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কাজললতা। প্রায় দোকানের সামনেই।
তারপর দ্বিতীয় ধাক্কা। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ওধারের ক্যাশবাক্সের সামনে মালিকের নির্দিষ্ট আসনটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে জাঁকিয়ে বসে আছে সম্পূর্ণ একজন অচেনা লোক।…বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে বয়স, রোগা, ঢ্যাঙা, পরিপাটি সাজ। উঠছে, তদারক করছে, আবার গিয়ে বসছে, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে নজর রাখছে, ক্যাশবাক্সে টাকা তুলছে।
দোকানের প্রায় দরজায় দাঁড়িয়েই নির্বাক বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকে দেখছে কাজললতা। মাথার মধ্যে সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেমন। সচকিত হয়ে খানিকটা পিছনে সরে এলো। মাথা উঁচিয়ে দুচোখ টান করে সাইনবোর্ডটা দেখল আবার।
দুজনার ঘর। সেই সাইনবোর্ড। লাল রক্তের অক্ষরে সেই লেখা। দুদিকে সেই দুটি নারী-পুরুষের মূর্তি। সেই ঘর।
কিন্তু এ কি দেখছে কাজললতা? আবার এগিয়ে একেবারে দরজার মুখে এসে দাঁড়াল। আবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখতে লাগল। বিশেষ করে মালিকের আসনের সেই লোকটাকে।
দুজনার ঘর জমজমাট বটে। যেমন তারা আশা করেছিল একদিন, প্রায় তেমনি। সে আর রাধাকান্ত। কাজললতা, আর রাধাকান্ত দুজনার ঘরের ওই বাইরের দিকটা বহুলোকের সমাবেশের প্রত্যাশাতেই খোলা ছিল। না, দুজনার ঘর বলতে সত্যিই দুজনের বাসের ঘর এটা নয়। কোনো কাব্যের ব্যাপারও নয়। এটা একটা সাইনবোর্ড। ওই সাইনবোর্ডে বড় বড় জ্বলজ্বলে রক্তের হরগে ওই কথাকটি লেখা। লেখার দুপাশে নিপুণ রঙের প্রলেপে একটি পুরুষমূর্তি আর একটি রমণীমূর্তি, আঁকা। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে আছে। এই চাওনিটুকু বড় জীবন্ত।
দুজনার ঘর বলতে দুজনার ঘর গড়ার উপকরণ যোগানোর দোকান এটা। বিজ্ঞাপনের চটকে বস্তুজগতে ভাগ্য বদলের অনেক বিস্ময়কর নজির আছে। কখন কোন্টা যে জনতার মনে দাগ কেটে বসবে বা চোখে ঘোর লাগাবে, তার স্থিরতা কিছু নেই। দাগ পড়ল কি ঘোর লাগল, অমনি কপাল ফিরল।
দুজনার ঘরের এখন অন্তত সেই কপাল। দলে দলে মেয়ে পুরুষ আসছে, জিনিস কিনছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। যে-কোনো বয়সের স্বামী-স্ত্রী অথবা যুগ্ম দয়িতা এই পথে। চললে ওই সাইনবোর্ডটা তাদের চোখ টানবে। পরস্পরের দিকে চেয়ে তারা মুখ টিপে হাসবে। কিছু কেনার থাকলে তারা এই দোকানেই ঢুকে পড়বে।
দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তারপর নিজের অগোচরে একটু একটু করে কাছে এসে এসেও এই দৃশ্যই দেখছিল কাজললতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কিন্তু সত্যিই এ কি দেখছে সে? মালিকের আসনে ওই লোকটা কেন? চোখে। পলক পড়ে না কাজললতার। দোকান-ঘেঁষা ফুটপাথে যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে আছে, কত লোক যে তাকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে হুশ নেই। লক্ষ্য দোকানের মালিকও করল এক সময়। ভিতরের ভিড় কমেছে, তাই দেখছে। তারপর অনেকবারই চোখ গেল সেদিকে। উঠে এলো এক সময়। সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিছু নেবেন? ভিতরে আসুন না–
কাজললতা থতমত খেল একপ্রস্থ। তারপর লোকটাকে আবার দেখল একটু। ভিতরে এসে দাঁড়াল সে। মহিলাটির হাবভাব দেখে দোকানের মালিক নন্দ ঘোষ বিস্মিত। উৎসাহিত হবার মত খদ্দের নয় কিছু, আটপৌরে বেশবাস, মোটসোটা গড়ন, কপালে নয়া পয়সার থেকে বড় জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ। দেখলেই বোঝা যায় তেমন অবস্থাপন্ন নয়, তেমন আধুনিকা তো নয়ই। তবু তার ঈষৎ-বিমূঢ় চাউনির মধ্যে কি যেন ছিল যা নন্দ ঘোষের খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি।
জিজ্ঞাসা করল, কি চাই বলুন?
কাজললতা আত্মস্থ হল এবার। কিছু বলতে হবে। অস্ফুটস্বরে বলল, মালিককে…
নন্দ ঘোষ এ রকম চাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না খুব।–আমিই মালিক, বলুন কি বলবেন?
তার মুখের ওপর কাজললতার চাওনিটা বদলাতে লাগল আবার। শূন্য দৃষ্টি লোকটার মুখের ওপর ঘুরল বারকয়েক। কি বলবে বা কিছু না বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসবে কিনা ভেবে পেল না।
আর নন্দ ঘোষের মনে হল, যা বলতে চায় এই অপরিচিতা, তা বোধহয় এত লোকজনের সামনে বলতে পারছে না। এখন ভিড় আরো পাতলা হওয়ায় ওই ছোঁড়া হুঁড়িগুলো এদিকেই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। এই অজ্ঞাত রমণীর প্রতি তার একটু কৌতূহল হল কেন কে জানে?…কিছু বলতে চায় নিশ্চয়, নইলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ও-ভাবে অতক্ষণ ধরে দোকানের দিকে চেয়ে ছিল কেন? আর ভিতরে এসেই বা। মালিকের খোঁজ করল কেন?
আচ্ছা, এদিকে আসুন
মালিকের আসনের পিছনে ছোট একটা খুপরি ঘর। এটা নিজস্ব বিশ্রামের ঘর নন্দ ঘোষের। সেখানেই নিয়ে এলো কাজললতাকে। তাকে বসতে বলল, তারপর। আবার জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?
কি বলবে কাজললতা? এ পর্যন্ত আসবে তা তো ভেবে আসেনি। একবারে ভিতরে ঢুকবে তা তো কল্পনাও করেনি। এই আসা, এই বসা, সব নিজের অজ্ঞাতসারেই ঘটেছে। কিন্তু জবাব কিছু দিতে হবে। লোকটা চেয়ে আছে। সে-ই নাকি মালিক এই দুজনার ঘরের। তার ব্যবহারেই হয়ত লোকটার চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে কেমন!
জবাব মাথায় এলো চকিতে। উদ্ভট কিছু নয়, নিতান্ত প্রয়োজনের জবাব। বাস্তব জবাব। মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা উদগত অনুভূতি দমন করে নিতে হল আগে। এই পরিবেশ, এখানকার বাতাসই হঠাৎ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইল তাকে। ….এই চেষ্টাই আগে করবে বই কি কাজললতা। দরকারও তো। …যদি হয়, তারপর সবই জানতে পারবে।