ঘণ্টাতিনেক নরিসের ঘরেই ঘুমালো চ্যাটার্জী, তারপর নরিস ঠেলে তুলল তাকে। তাকে নিয়ে সে প্যাট মেনডোনসার বাড়ি যাবে কোট আনতে।
ঘুম তাড়িয়ে নরিসের সঙ্গ নিল চ্যাটার্জী। যে মেয়ে ওভাবে নিজেকে এগিয়ে। দিতে চেয়েছিল, তাকে একবার দেখার কৌতূহলও ছিল। চিরকুটের নম্বর মিলিয়ে বান্দার বাড়ির ঠিকানায় এসে দাঁড়াল তারা। কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধ দরজা খুলে দিলেন।
নরিস প্যাট মেনডোনসার খোঁজ করতে বৃদ্ধটি খানিক চেয়ে রইলেন মুখের দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কে?
নরিস জানালো তারা কে এবং কেন এসেছে। গত রাতের ফাংশানে শাত করছিল বলে প্যাট মেনডোনসা তার কোট গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে, সেই কোটটা ফেরত নিতে এসেছে তারা। নাম ঠিকানা লেখা চিরকুটটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল নরিস।
বৃদ্ধ দেখলেন। গম্ভার। বললেন, আচ্ছা আপনারা বসুন একটু
ভিতরে চলে গেলেন তিনি। একটু বাদে বাঁধানো একটা ফোটো হাতে ফিরলেন। সেটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন তো, এর মধ্যে কেউ কাল আপনার কোট নিয়ে এসেছিল কিনা।
বৃদ্ধের ব্যবহারে এরা দুজনেই মনে মনে বিস্মিত। সামনে আট-দশটি নারীপুরুষের বড় গ্রুপ ফোটো একটা। সেটার দিকে এক নজর তাকিয়ে আঙুল দিয়ে প্যাট মেনডোনসাকে দেখিয়ে দিল নরিস। বলল, ইনি–
দু চোখ টান করে বৃদ্ধ নরিসের দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। নরিস জিজ্ঞাসা করল, ইনি কি এ বাড়িতে থাকেন না?
থাকত এখন থাকে না। আমার এই মেয়ে দুবছর আগে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
নরিস আর তার সঙ্গে চ্যাটার্জীও কি সত্যি শুনছে, নাকি এখনো রাতের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে! সত্যিই কোথায় তারা?
চেতনারহিতের মত আরো একটু খবর শুনল। বৃদ্ধ জানালেন, বাড়ির সব থেকে সেরা মেয়ে ছিল এই প্যাট মেনডোনসা–মাটিন ডিসুজা নামে এক ছেলেকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সকলে ধরেও নিয়েছিল বিয়ে হবে। কিন্তু ডিসুজার বাপ-মার বড় গর্ব তারা ব্রাহ্মিন ক্রিশ্চিয়ান–বিয়ে হতে দিলে না। বিয়ে হবে না শুনে মেয়েটার মাথাই হয়ত বিগড়ে গিয়েছিল, নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল ডিসুজার বাড়ি থেকে–দাদারে সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট হল–তক্ষুনি শেষ। অ্যাকসিডেন্টের খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল।
অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটাল নরিস। চ্যাটার্জী ঠেলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল না। মুখে কথা নেই। কেমন যেন হয়ে গেছে। খানিক বাদে ফুল কিনল এক গোছা, চ্যাটার্জীকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠল।
সমাধিক্ষেত্র। নিঃশব্দে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে দুজনে। বেশি খুঁজতে হল না। হঠাৎ একদিকে চোখ পড়তে নিস্পন্দ কাঠ দুজনেই। ওই ছোট সমাধি একটা– সমাধির ওপর ক্রস। ক্ৰs-এ ঝুলছে নরিসের সেই কোট। সমাধির গায়ে নামের হরপ–প্যাট মেনডোনসা।
নির্বাক স্তব্ধ দুজনেই। অভিভূতের মত কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সমাধির সামনে হুশ নেই।
নরিস ফুল দিল। ক্রস-এর ওপর থেকে কোটটা হাতে তুলে নিল। বলল, চলো–
ফিলিপ নরিসের হাতে কোটটা দেখে কি এক অজ্ঞাত অস্বস্তি বোধ করছিল চ্যাটার্জী। কিন্তু বলা হয়নি, ওটা থাক।
দুজনার ঘর
তৃতীয় মানুষ এলে দুজনার ঘর টেকে না।
অনেক, অনেক মূল্য দিয়ে তবে এই সার জেনেছে কাজললতা।
.
বিস্ময়ের তাড়নায় তার ভয় উবে যাবার দাখিল। অনেকক্ষণ সঙ্গোপনে দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে। জমজমাট মনে হয়েছে দোকানটা। জলুস বেড়েছে, লোকজন বেড়েছে, খদ্দের বেড়েছে। দেখছিল আর বুকের তলায় কাটা-ছেঁড়ার ওপর যেন এক ধরনের খুশির প্রলেপ পড়ছিল।
কিন্তু নিভৃতের রোমাঞ্চ মিলিয়ে আসতে চোখের নজর বাড়ছিল। কাজললতার খটকা লাগছে কেমন। অত দূর থেকে ভালো ঠাওর করতে পারছে না। যদিও ওখানকার। ভিতরের আলো দিনের আলোর মত সাদা। তবু কি যেন এক ব্যতিক্রম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। একটাও চেনা মুখ চোখে পড়ছে না। পায়ে পায়ে এগোলো আরো একটু। জনা দুই অল্প বয়সের ছেলে কাজ করছে, আর তিনটি মেয়ে। আঠেরো থেকে বাইশ চব্বিশের মধ্যে হবে মেয়েগুলোর বয়েস। কাজললতা আরো একটু এগিয়ে তাদের দেখছে ভালো করে। চোখের দৃষ্টিটা খরখরে হয়ে উঠছে। এ আবার কি? এ কি দেখছে। কাজললতা?
নিজের জীবন-যাত্রা যেমনই হোক, সকল সংশয়ের উর্ধ্বের কোনো উগ্র শুচিশুদ্ধ মানুষকে জীবনের জটিল রাস্তায় চলতে দেখলে মন হঠাৎ যেমন ধাক্কা খায়, ওই মেয়েগুলোকে দেখে প্রায় তেমনিই একটা ধাক্কা খেয়ে উঠল, কাজললতা।
নিজের অগোচরে পায়ে পায়ে আরো একটু এগলো সে।
সুন্দর দূরে থাক, তেমন সুশ্রীও নয় একটা মেয়েও। তবে সাজগোজে শ্রী বাড়াবার চটক আছে। যে চটকে শ্ৰী আসলে নিষ্প্রভ হয়, কিন্তু চোখ টানে। পরনে উগ্র রঙের শাড়ি, গায়ে গলা ঘেঁষা টেপ ব্লাউস, হাতে এক এক বোঝা রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি, গালে ঠোঁটে রঙ।
এই বৈচিত্র্যের বুদ্ধি একদিন কাজললতাই দিয়েছিল। জীবিকার্জনের সেই যুগ্ম আসরে সে-ই প্রথম এবং একমাত্র নায়িকা ছিল। কিন্তু এ আবার কি? লোকটা কি এতদিনে তাহলে এই জটিল যুগে তাল ঠকে চলার সহজ রাস্তাটা চিনে ফেলেছে? কাজললতা যখন ওই আসরের নায়িকা ছিল, তখনো হয়ত লক্ষ্যের তফাৎ ছিল না খুব। কিন্তু এ যেন রাতের নিভৃতে প্রত্যাশার তাগিদে ঘরের স্ত্রীর কাছে আসা আর গণিকালয়ে যাওয়ার মধ্যে যেটুকু তফাৎ, অনেকটা সেই রকম। রুচির তফাৎ, শালীনতার তফাৎ।