এ-রকম বিদায়টা যেন খুব পছন্দ নয় মেয়েটির, মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে নাম, বাড়ির নম্বর আর ঠিকানা লিখে দিল। কাগজটা নিজের পকেটে রেখে নরিস বলল, চলো তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আসি।
দোতলার সিঁড়ির কাছে আসার আগেই সামনের লম্বা প্যাসেজের দিকে চোখ পড়তে মেনডোনসা দাঁড়াল।-ও-দিকটা কি?
বাথ…
অস্ফুট স্বরে বলল, আমি যাব, দেখিয়ে দাও
প্যাসেজ ধরে পায়ে পায়ে খানিকটা এগিয়ে নরিস দাঁড়াল। প্যাট মেনডোনসা হালফ্যাশানের মস্ত বাথরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। গম্ভীর ক্লান্ত দুটো চোখ আবার নরিসের মুখে এসে আটকালো। মাথা নেড়ে ডাকল তাকে।
ঈষৎ বিস্মিত মুখে সে কাছে আসতে বলল, তুমিও এসো।
হঠাৎ হতভম্ব বিমূঢ় নরিস। বলে কি! এ কার পাল্লায় পড়ল সে! তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠল, না না, কিছু ভয় নেই, তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি।
রমণীর নিষ্পলক দুই চোখ তার মুখের থেকে নড়ছে না। এই মুখে আর চোখে একটা কঠিন ছায়া পড়ছে। শান্ত ঠাণ্ডা গলায় আবার বলল, তুমিও এসো।
প্রায় আদেশের মত শোনালো। নরিস ঘাবড়েই গেল। কপালে ঘাম দেখা দিল। এ কি সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই–নাকি এও মানসিক রোগ কিছু! বিস্ময় সংবরণ করে এবারে জোর করেই মাথা ঝাঁকালো নরিস, বলল, আঃ, কেউ এসে পড়লে কি ভাববে! বলছি তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি
প্যাট মেনডোনসা চেয়েই আছে– চেয়েই আছে। তারপর আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজা খুলল সে। ভিতরে ঢুকল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল নরিসের।…ভালয় ভালয় এখন ট্যাক্সিতে উঠলে হয়!
জানালায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। অদ্ভুত মেয়েটার কথাই ভাবছে।
হঠাৎ সচকিত। একটা আস্ত সিগারেট শেষ হয়ে গেল, আর একটা কখন ধরিয়েছে এবং আধাআধি শেষ করেছে খেয়াল নেই–অথচ প্যাট মেনডোনসা এখনো বেরোয়নি। বাথরুমের দরজা বন্ধ।
দ্বিতীয় সিগারেট শেষ হল। নরিস পায়চারি করছে। কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই।
তারপর আরো আধঘণ্টা কেটে গেল। নরিস বিলক্ষণ ঘাবড়েছে। দরজা ঠেলেছে, দরজায় মৃদু আঘাত করেছে, ডেকেছে–কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা করে মিনিট গেছে আর নরিসের ভয় বেড়েছে। গোড়া থেকেই কেমন লাগছিল মেয়েটাকে–ভিতরে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেল, নাকি কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসল!
ঘড়ি দেখল! সাড়ে তিনটে বেজে গেছে রাত্রি। তার মানে একঘন্টার ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে প্যাসেজে! বিমূঢ় নরিস কি করবে দিশা পেল না। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিল কয়েকবার। মজবুত দরজা একটু কঁপল শুধু।
নরিস দৌড়লো হঠাৎ। আধভাঙা আসর থেকে চ্যাটার্জীকে খুঁজে বার করল। চ্যাটার্জী প্রকৃতিস্থই আছে বটে, কিন্তু নিজের হাতপায়ের ওপর দখল খুব নেই। তাকে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে এলো নরিস। চ্যাটার্জীর পিছু পিছু আর দুই-একজন উৎসুক বন্ধুও এলো। খুব সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনে তারাও অবাক। খানিকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করল তারাও।
শেষে কেয়ারটেকারের তলব পড়ল। বেগতিক দেখে কেয়ারটেকার পুলিসে ফোন করল। পুলিস এসে দরজা ভাঙল যখন, তখন প্রায় সকাল।
ভিতরে কেউ নেই।
একসঙ্গে বহু জোড়া বিস্মিত দৃষ্টির ঘায়ে নরিস বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। বাহ্যচেতনা লোপ পাবার উপক্রম তার।
সুরার ঝোঁকে দুই-একজন ঠাট্টা করল, নরিসের প্রেয়সী বাথরুমের জানালা দিয়ে নিশ্চয় পাখী হয়ে উড়ে পালিয়ে গেছে! নইলে ভিতর থেকে উধাও হবার আর কোন পথ নেই!
কেয়ারটেকার বা পুলিসের লোকেরও ধারণা হল, নরিস বেসামাল হয়েছিল হয়ত, ভিতরে যে ঢুকেছিল সে কখন বেরিয়ে চলে গেছে খেয়াল করেনি–আর বাইরে থেকে দরজার হ্যাঁণ্ডেল টানাহেঁচড়ার ফলে হোক বা অন্য কোন অস্বাভাবিক কারণে হোক ভিতরের ল্যাচ আটকে গেছে। বাইরে থেকে টানাহেঁচড়া করে বা কোনরকম অস্বাভাবিক কারণে এই দরজার ল্যাচ আটকে যেতে পারে কিনা–এই দিনের এই সময়ে তা নিয়ে গবেষণা করার মত ধৈর্য কারো নেই।
চ্যাটার্জী হতভম্ব নরিসকে একদিকে টেনে এনে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, রাত্তিরে কতটা খেয়েছিলে?
নরিস সত্যি কথাই বলল, কিন্তু চ্যাটার্জীর সংশয় গেল না। বলল, অভ্যেস নেই–ওটুকুতেই গণ্ডগোল হয়েছে।
তাকে বিশ্বাস করানোর ঝোঁকে পকেট থেকে চিরকুট বার করল নরিস, এই দ্যাখো, আমার কোট গায়ে দিয়ে গেছে, নিজের হাতে নাম বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছে
চ্যাটার্জী দেখল। রাতের ধকলে তার মাথাও খুব পরিষ্কার নয়। তবু একমাত্র সংগত মন্তব্যই করল সে। বলল, তাহলে তুমি যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট খাচ্ছিলে তখনই বেরিয়ে চলে গেছে সে- তুমি টের পাওনি। নিশ্চয় তোমার মতলব ভালো মনে হয়নি তার, তাই
নরিস তখন আদ্যোপান্ত ব্যাপারটাই বলল তাকে। মতলব যে কার ভালো ছিল না তাও গোপন করল না। শুনে চ্যাটার্জী হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পেল না।
এদিকে চ্যাটার্জীর ওই শেষের যুক্তিই সম্ভবপর মনে হয়েছে নরিসের। সে যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট টানতে টানতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা তার অলক্ষ্যে তখনই চলে গিয়ে থাকবে। এ ছাড়া কি আর হতে পারে! তার অনভ্যস্ত জঠরে ওই সামান্য সুরাই হয়ত কিছুটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তাকে। আর, মেয়েটা যে রুষ্ট হয়েছিল সে তো বোঝাই গেছে–তাই কোনরকম বিদায়সম্ভাষণ না জানিয়েই চলে গেছে।