করেনি সত্যি। চ্যাটার্জী নিজেই করেনি। কিন্তু তারপরে যা সে দেখেছে অবিশ্বাস করবে কি করে! তবু নিজেরই তার বার বার ধাঁধা লাগছে, ধোঁকা লাগছে। ফিলিপের না-হয় মাথার গণ্ডগোল হয়েছিল, কিন্তু তারও কি হয়েছিল? বন্ধুর কথামত কাগজে বিজ্ঞাপন একটা দিয়েই দেখবে? পরমুহূর্তে কি আবার মনে পড়েছে না, ভুল কিছু হয়নি, যারা জানে না তাদের এ-রকম ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু চ্যাটার্জী ভাববে কি করে? এ যদি ভুল হয় তা হলে তার এই মুহূর্তের অস্তিত্বও ঠিক কিনা সন্দেহ।
যাক, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবকাশও আর কিছু থাকল না। ডাক্তারের ওষুধ আর ইনজেকশনে ফিলিপ নরিস চোখ বুজেছে। সেই চোখ মেলে সে আর তাকায়নি। তার সেই রাতের ঘুম আর ভাঙেনি। কখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে নার্সও টের পায়নি। বন্ধুরাও প্রদিন এসে তাকে মৃত দেখেছে।
.
এবরে আগের ঘটনাটুকু যোগ করলেও কাহিনী সম্পূর্ণ হবে কিনা বলা শক্ত।
ঘটনাস্থল বোম্বাইয়ের এক মস্ত নামজাদা ইঙ্গ-ভারতীয় ধাঁচের ক্লাব। নামজাদা ক্লাব না বলে নামজাদা সংস্থা বললেই বোধ করি ঠিক হবে। অনিবার্য কারণে নাম অনুক্ত থাক। এই ক্লাব বা ক্লাবের নিজস্ব প্রাসাদ-সৌধ সেখানকার সকলেই চেনেন। মেম্বাররা সর্বভারতীয় এবং কিছুটা সর্বদেশীয়। তবে একক সংখ্যার বিচারে গোয়ান মেয়ে-পুরুষের সংখ্যাই বোধ করি বেশি। এই গোয়ানদের মধ্যে আবার জাতের রেষারেষি আছে। গোড়া ব্রামিন-ক্রিশ্চিয়ান গোয়ানদের মাথা উঁচু-সামাজিক ব্যাপারে অধস্তন গোয়ানদের সঙ্গে সচরাচর তারা আপস করে না। কিন্তু এই ক্লাব অনেকটা শ্রীক্ষেত্রের মত। এখানে। জাত-বর্ণের খোঁজ বড় পড়ে না।
এখানে প্রবেশের প্রধান ছাড়পত্র আর্থিক সংগতি! যার টাকা আছে আর তারুণ্যের পিপাসা আছে তার কাছে ক্লাবের দ্বার অবারিত। বহু লক্ষপতি বা ক্রোড়পতি প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষক! নবীন সভ্য-সভ্যাদের টাকার জোরের থেকে দিল-এর জোর বেশি। টাকার থেকেও তাদের বড় মূলধন আনন্দ আহরণের উৎসাহ আর উদ্দীপনা! এই উৎসাহ আর উদ্দীপনার ফলেই সাধারণত সংস্থার মুরুব্বীদের সঙ্গে যোগযোগ ঘটে যায়। এখানে ইচ্ছার বেগই প্রধান। এখানে এসে হিসেবের খাতার পাতা খোলে না।
চ্যাটার্জী এখানে ভিড়তে পেরেছে টাকার জোরে নয়, তার কাগজের জোরে। আর কিছুটা তার সুপটু যোগাযোগের ফলে। সুমার্জিত কৌশলে সবজান্তার আসরে যে নামতে পারে, দুনিয়া উলটে-পালটে গেলেও খুব একটা কিছু যায় আসে না এমনি নির্লিপ্ত মাধুর্যে যে অবকাশ যাপন করতে পারে–এখানে তারই কদর বেশি। সেই হিসেবে চ্যাটার্জী প্রিয়পাত্র এখানকার। ফিলিপ নরিসের বিশেষ গুণ হল সে টাকা যা রোজগার করে তার থেকে বেশি খরচ করতে জানে। নিজের গতিবিধি আচার-আচরণ সরল, সংযত–অথচ বন্ধুবান্ধবরা তার বেশির ভাগই বেপরোয়া, সদা মুখর। কারো টাকার দরকার হলে অসঙ্কোচে হাত পাতো ফিলিপ নরিসের কাছে, হাতে থাকলে সে তক্ষুনি দিয়ে দেবে। না থাকলে, আর টাকার প্রয়োজন যার সে প্রিয়পাত্র হলে, ধার করে এনে দেবে। দিয়ে অনুগ্রহ করবে না, নিজেই অনুগৃহীত হবে। ব্যাঙ্কে মোটামুটি ভালো চাকরিই করে, ব্যাচিলর, তাই ভালো হোটেলে আলাদা একখানা ঘর নিয়ে থাকার। সংগতি আছে।
তাহলেও ফিলিপ নরিস ক্লাবের প্রথম সারির কেউ নয়। অর্থাৎ চ্যাটার্জর মত নিজের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সকল সভ্য বা সভ্যারা ভালো করে চেনেও না তাকে। তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির দরুন সভার আলো উজ্জ্বল বা স্তিমিত হয়। তার মত সাদামাটা সভ্যসংখ্যা শতকের ওপর। দুদশজনের কাছে যেটুকু খাতির সে পায়। তাও চ্যাটার্জীর সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার দরুন। এইজন্যই চ্যাটার্জীর প্রতি সদা কৃতজ্ঞ সে। কৃতজ্ঞতার আরো কারণ আছে, চ্যাটার্জীর সক্রিয় সহযোগিতায় তার কাগজে নরিসের দুই-একটা আবেগমুখর প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে। তিরিশ টাকা দক্ষিণ পেলে আনন্দাতিশয্যে ষাট টাকা খরচ করে বসেছে সে, তবু চ্যাটার্জীর ঋণ শোধ হয়েছে। ভাবেনি।
গুণমুগ্ধ দুই-একটি ভক্ত সকলেই পছন্দ করে। চ্যাটার্জীরও ভালো লাগে ফিলিপ নরিসকে।
ক্লাবের বার্ষিক উৎসবের রাত সেটা। গোটা প্রাসাদ আলোয় আলোয় একাকার। ছমাস আগে থেকেই এই একটা রাতের প্রতীক্ষা করে থাকে সকলে। এক রাতের উৎসবে কত হাজার টাকা খরচ হয় সে প্রসঙ্গ অবান্তর। সভ্য এবং অতিথি-অভ্যাগতদের গাড়ির ভিড়ে প্রাসাদসৌধের সামনের দুটো বড় বড় রাস্তার অনেকটাই আটকে থাকে।
সমস্ত রাতের উৎসব-খাওয়াদাওয়া নাচগানের ঢালা ব্যবস্থা। যে সময়ের ঘটনা, বোম্বাই শহর তখন ড্রাই নয়, অতএব বহুরকম রঙিন পানীয়ের ব্যবস্থারও ত্রুটি ছিল না কিছু। রাত বারটার পরে ডান্স হলে যখন নাচের ডাক পড়ল, নিজের নিজের দুটো পায়ের ওপর তখন অনেকেরই খুব আস্থা নেই।
…সেই মেয়েটির দিকে আবার চোখ পড়ল ফিলিপ নরিসের। এই নিয়ে বারকয়েক চোখ গেল তার দিকে। খুব রূপসী না হলেও সুশ্রী। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে বয়স। এই উৎসবে এই বয়সের সঙ্গীহীন মেয়ে বড় দেখা যায় না। ডান্স হলের দরজার ওধারের দেয়াল ঘেঁষে কেমন যেন বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একা। সকলেই যে নাচছে তা নয়, কিন্তু ওই মেয়েটির মত একা কাউকে মনে হল না নরিসের। মুখখানা মিষ্টি কিন্তু বড় শুকনো–এক ধরনের বিষণ্ণ ঘুম-জড়ানো চোখ-মুখ-চাউনি। এই পরিবেশ মেয়েটির যেন পরিচিত নয় খুব–মনে হল সেই থেকে সে যেন কাউকে খুঁজছে। অন্যমনস্কর মত নাচ দেখছে এক-একবার, আবার শ্রান্ত দৃষ্টিটা এদিক-ওদিক ফিরিয়ে আগন্তুকদের মুখ দেখে নিচ্ছে।