সাত আট মিনিট নয়, দুমিনিট দেরি হয়েছে ফিরতে। স্ত্রী ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করেছিলেন শুনলেন। তারপর একাই ডান্স-ড্রামা দেখতে চলে গেছেন। ….ঠিক এক মিনিট আগে।
.
তার একত্রিশ, লতার ছাব্বিশ।
গৌরকিশোর বিয়ে করেছেন পাঁচ বছর আগে। করেছেন বলা ঠিক হল না, তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বিয়েটা তার জীবনে এক অভাবিত ঘটনা। তিনি বাস্তববাদী মানুষ, জীবনে কোনদিন আকাশকুসুম কল্পনায় বিভোর হননি। কিন্তু বাস্তবের আকাশ থেকে তাঁর জীবনে ভাগ্যের এক দুর্লভ কুসুম খসে পড়েছে। বিয়ের পর নয়, বিয়ের প্রস্তাব শুনেই তিনি বিহ্বল হয়েছিলেন।
তাঁর বাবা ছিলেন বনেদী লোহার কারবারী চ্যাটার্জী মেটালস-এর পাঁচজন অ্যাকাউনটেন্ট-এর একজন। দুদুটো যুদ্ধের কল্যাণে চ্যাটার্জী মেটালস-এর ভাগ্য আর। খ্যাতির তুঙ্গস্থানে বৃহস্পতির অনড় অবস্থান। কিন্তু গৌরকিশোরের বাবা আনন্দকিশোর সচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন মাত্র মাসকতকের জন্যে। গৌরকিশোর বি. এ. পাশ করার পরে।
বিধাতার খেয়ালের কুল মেলা ভার। নইলে বলা নেই কওয়া নেই, গৌরকিশোরের অ্যাকাউনটেন্ট বাবা ম্যানেজিং ডাইরেক্টারের খাস বেয়ারার মুখে বড়া সাব সেলাম দিয়া শুনে তো ঘামতে ঘামতেই ছুটেছিলেন তার এয়ার কনডিশল্ড চেম্বারের দিকে। মাঝে এক ঝুড়ি ছোট বড় হোমরাচোমরা অফিসারের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ তাকে তলব কেন ভেবে না পেয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। নমাসে ছমাসে ডাক যদি কখনো পড়ে তো আর পাঁচজন অফিসারের নির্দেশে তাদের সঙ্গ ধরে ঘরে ঢোকেন, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শোনেন, তারপর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে অফিসারদের ইঙ্গিত বুঝেই আবার বেরিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। শুধু অফিসাররা কেন, ওই ঘর থেকে ডাক এলে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের বড় দুই ছেলে পর্যন্ত সভয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছোটেন-বাপের পরেই যাঁরা এত বড় কোম্পানীর হর্তাকর্তা।
সেই ঘর থেকে একা অ্যাকাউনটেন্টের ডাক আসাটা মেঘশূন্য আকাশ থেকে একটা বাজ পড়ার মতই।
ঘরে ঢুকে দেখেন ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সামনে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট দত্ত সাহেব বসে। কোম্পানীর বাৎসরিক আয়-ব্যয় লাভ-লোকসানের হিসেব-নিকেশ তিনিই করে থাকেন। ওই হিসেবপত্রের সুতো ধরেই তাঁর সঙ্গে আনন্দকিশোরের অনেক দিনের যোগাযোগ। ভদ্রলোক স্নেহ করতেন তাকে। দুজনের কারো মুখই বিপজ্জনক রকমের গম্ভীর নয় দেখে মনে মনে স্বস্তিবোধ করেছিলেন একটু।
–বোসো। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সহজ আপ্যায়নে হকচকিয়ে গেছলেন তিনি। আদেশ পালন করার মত করে দত্ত সাহেবের পাশের চেয়ারে বসেছিলেন। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জীর বয়েস প্রায় পঁয়ষট্টি, আর আনন্দকিশোরের ছেচল্লিশ –কিন্তু এই তুমি বলার মধ্যে খুব প্রচ্ছন্ন একটু অন্তরঙ্গ স্পর্শও পেলেন যেন।
–তোমার ছেলে স্কুল ফাইনালে সেকেণ্ড হয়েছিল?
প্রশ্নটা এত অপ্রত্যাশিত যে প্রায় দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল।
–আজ্ঞে হ্যাঁ..
–আই, এসসি-তে ফার্স্ট হয়েছিল?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–এবারে বি, এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–কোন সাবজেক্ট?
–আজ্ঞে অঙ্ক।
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী কৃতী ছেলের বাপের মুখখানা পর্যবেক্ষণ করলেন একটু।–তুমি কত মাইনে পাও এখন?
–আজ্ঞে তিনশ সত্তর।
–ছেলেকে বাড়িতে পড়াতো কে, তুমি না মাস্টার?
–আজ্ঞে ও নিজেই পড়ত।
–এখন এম, এ পড়বে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–ছেলেটিকে একবার নিয়ে এসো তো, দেখব। আই অ্যাম সো গ্ল্যাড টু হিয়ার
বড় সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে আনন্দে ঘেমে ওঠার দাখিল। প্রতিবারের। সুখবরের মত ছেলের সুখবরটা সেই সকালেই দত্ত সাহেবকে জানিয়েছিলেন তিনি।
যতটা সম্ভব ভব্যসভ্য করে ছেলেকে পরদিনই বড় সাহেবের ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। বাবার সেই চাপা উত্তেজনা আর ব্যস্ততা দেখে গৌরকিশোর হকচকিয়ে গেছলেন। ঘাবড়ে গিয়ে প্রণাম করার তাড়ায় চেয়ারের আড়ালে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের দ্বিতীয় পা খুঁজে না পেয়ে এক পায়ের জুতোর উপরে দুবার হাত বুলিয়ে মাথায় ঠেকিয়েছেন। কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী ঈষৎ কৌতুকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাকে।
কিন্তু তার মন্তব্য শুনে বাপের মুখে কাষ্ঠ হাসি আর ছেলের মুখে বিড়ম্বনার ধকল। বড় সাহেব হেসে বলেছেন, লেখাপড়ায় তুমি এত ভালো…বাট ইউ ডোন্ট লুক দ্যাট স্মার্ট।
বাবা বার বার করে বলে দিয়েছিলেন, হাবাগোবার মত চুপ করে থাকিস না, একটু আধটু কথা বলবি। অতএব চুপ করে না থেকে গৌরকিশোর কথাই বলেছেন। –চেষ্টা করিনি স্যার…
কৌতুকে নড়েচড়ে বসেছেন কৃষ্ণকমল চ্যাটার্জী।–কি চেষ্টা করোনি, স্মার্ট হতে?
এবারে আর জবাব জোগালো না, মাথাই নাড়লেন শুধু অর্থাৎ তাই।
–কি চেষ্টা করেছ?
গৌরকিশোর ফাঁপরে পড়েছিলেন, জবাব দিয়েছেন, একবার সেকেণ্ড হবার পর। থেকে ফার্স্ট হতে চেষ্টা করেছি।
আর একটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বড় সাহেবের ঠোঁটের ডগার হাসি আরো স্পষ্ট হয়েছিল।–চেষ্টা করলে স্মার্ট হতেও পারো বলছ?
নিরুপায় গোছের মাথা নেড়েছিলেন গৌরকিশোর– পারেন।
হাসি মুখে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর উপদেশ দিয়েছেন, আচ্ছা এম, এ-তে ফাস্ট হবার পর সে চেষ্টা কোরো। ভেরি গ্ল্যাড টু মিট ইউ