রাত নটা বেজে গেছে।
বিউটি হাউসের গেট বন্ধ। কর্মচারী-কর্মচরিণীরা বিদায় নিয়েছে। কোমর-উঁচু ঝকঝকে কাঠঘেরা গণ্ডীর মধ্যে মালিকের নির্দিষ্ট গদি-আঁটা-আসনে বসে গভীর মনোযোগে হিসেব দেখছে ভাটনগর।
হল এর অন্য প্রান্তে নিজের জায়গায় বসে সেদিনের বিক্রির মেমো ওলটাচ্ছে ভূতনাথ। মাঝে এক-আধবার চোখ যাচ্ছে তার বিপরীত কোণের দিকে, যেখানে ক্রেতা অভ্যাগতদের জন্য সৌখীন সোফা-সেটি পাতা। কৌচের ওপর দেহ এলিয়ে দিয়েছে স্বপ্না বোস। শুধু এখন নয়, কাজের মধ্যেও আজ একাধিকবার নিবিষ্ট-চিত্ততায় ছেদ পড়েছে ভূতনাথবাবুর। ওই নারীমুখের হাস্যলাস্যের মাত্রাটা আজ বেড়েছিল, একটু একটু করে বেড়েই যাচ্ছে যেন। ছোট ছোট ঘরে নিরিবিলি সান্নিধ্যে আজ দুবার দুটো লোকের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ ধরে, তাও লক্ষ্য করেছে। মেমো লেখা ছেড়ে ভূতনাথ মুখ তোলে না বড়। কিন্তু চোখ এড়ায় না কিছু, ভূতনাথবাবু সব দেখে।
কৌচের ওপর স্থাণুর মত পড়ে আছে স্বপ্না বোস। শ্রান্ত, ক্লান্ত। প্রায় নির্জীব যেন। ভালো লাগছে না কিছুই ভালো লাগছে না। কান্নার মত একটা বিষাদের তরল স্রোত বইছে সর্বাঙ্গে। ভাবছে, কিছু ভাববে না, ভাবলেই তো ভাবনার বিভীষিকা বাড়ে। ভাবছেও না কিছু, তবু দুর্বোধ্য বোঝার মত কি যেন বুকে চেপে আছে।
অদ্ভুত নীরবতা বিউটি হাউসে। সবগুলো আলো জ্বলছে তেমনি। তেমনি ঝকঝক করছে শো-কেইসের দ্রব্যসম্ভার। কোথাও টু-শব্দটি নেই। শুধু তিন কোণে তিনটি প্রাণী। সামনের দরজা বন্ধ। পিছনের পথ দিয়ে বেরোয় তারা। প্রাসাদ-সৌধের পিছনদিকেও একাধিক নির্গমনের ব্যবস্থা আছে। সেদিক দিয়ে বেরুলে বাড়ির মধ্যেই দশ দিকে দশ পথ।
ঠং করে ঘড়িতে শব্দ হল একটা। সাড়ে নটা বাজল। কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। স্বপ্না বোস। অলস মন্থর গতিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ভূতনাথবাবুর কাছে।
মুখ না তুলেই ভূতনাথ বলল, বোসো।
–হয়নি তোমার?
–হয়েছে। মেমো-বইয়ের ওপর পেপারওয়েট চাপা দিয়ে চোখে চোখ রাখল। তার। তেমনি মড়া-চোখ, ভাবলেশহীন, নির্বিকার। সে চোখে এতটুকু আগ্রহ নেই।
সামনের চেয়ারে বসে পড়ল স্বপ্না বোস। বিরক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছ?
–কিছু না,খুব ক্লান্ত?
–নাঃ, ভালো লাগছে না কিছু।
–লাগবে না তো!
–কেন? কণ্ঠস্বরে তিক্ততা প্রকাশ পায় আবার।
ভূতনাথ শান্ত কণ্ঠে বলল, এখন শুধু ভালো লাগছে না, আর কিছুদিন বাদে তিলে তিলে জ্বলতে হবে। জেনে-শুনে নিজে দুঃখ সৃষ্টি করলে দুঃখের শেষ কোথায়?
–থামো, থামো! অস্ফুটকণ্ঠে প্রায় গর্জে ওঠে স্বপ্না বোস। চাপা কর্কশ স্বরে বলে ওঠে, খুব সাহস দেখি যে?
-হ্যা-ল-লো! ডোন্ট ফাইট মাই ডিয়ার!
শশব্যস্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল দুজনেই। মেঝেতে পুরু কার্পেট পাতা, পায়ের শব্দ শোনা যায় না। ভাটনগর কখন এসেছে দুজনের কেউ খেয়াল করেনি।
–সিট ডাউন, সিট ডাউন প্লীজ!
বসল দুজনেই।
এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ভাটনগর একটা শূন্য চেয়ারে এক পা তুলে দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ডাকল, স্বপ্না?
-ইয়েস স্যার!
— –তোমাকে কিছু বলবার আছে।
–ইয়েস স্যার…
ভাটনগর তীক্ষ্ণ চোখে তাকে নিরীক্ষণ করল আবার একটু।-ইউ সিম টু ফরগেট ইওরসেলফ..অপরকে ভোলানো আর নিজে ভোলা এক কথা নয়…ডোন্ট রিসিভ ইনডিভিজুয়াল অ্যাটেনশান অ্যান্ড ইনভাইট ট্রাবলস…আণ্ডারস্ট্যাণ্ড?
শুষ্ককণ্ঠে স্বপ্না বোস জবাব দিল, ইয়েস স্যার…।
–গুড নাইট!
পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ভাটনগর। আর হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলে উঠেছে স্বপ্না বোসের দুই চোখ। সে অদৃশ্য হবার পরেও সেই দিকে চেয়ে নিঃশব্দে আগুন ছড়ালো আরো খানিকক্ষণ।
পরে মাথা রাখল ভূতনাথের টেবিলের ওপরেই।
চেয়ার ছেড়ে ভূতনাথ উঠে দাঁড়াল। এক দিকের কাঁচের আলমারি খুলে একটা আরকের শিশি বার করল। ড্রপারে করে সাদা জলের মত আরক তুলে নিল কয়েক ফোঁটা। কাছে এসে বলল, ওঠো রাত হয়েছে, এর পরে তো আরো কতক্ষণ লাগবে ঠিক নেই!
স্বপ্না বোস মাথা তুলল। কিছুটা সংযত, কিছুটা শান্ত। নিজেই দুহাতের আঙুলে করে একটা চোখের ওপর নিচ টেনে ধরে আলোর দিকে মুখ ফেরালো। ভূতনাথ ড্রপ ফেলল চোখে। একে একে দুই চোখেই।
নীরবে উঠে গেল স্বপ্না বোস। এক কোণের আড়াল থেকে একটা পেটমোটা ভারী চামড়ার হাতব্যাগ তুলে নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ভূতনাথ বসে আছে। নীরব, নিস্পন্দ। যেন ঘুমিয়ে আছে। কোন তাড়া নেই। কোন চাঞ্চল্য নেই। সময় কেটে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ বাদে ওই ব্যাগ হাতে নিয়েই আবার দেখা দিল যে নারী, তাকে চিনবে না বিউটি হাউসের অতি পরিচিত কোন খদ্দেরও।
ঘড়ির দিকে তাকালো ভূতনাথ। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। হবার কথা। রোজ ঘণ্টাতিনেক লাগে যে প্রসাধন সম্পূর্ণ হতে, সেটা তুলতে কম করে এক ঘণ্টা তো লাগবেই। এমনিতে ওঠে না, ওই হাতব্যাগে আছে নানা রকম রাসায়নিক নির্যাস– সেটা যথাস্থানে রেখে ভূতনাথের মুখোমুখি বসল আবার।
সদ্যস্নাতা। আটপৌরে বেশবাস। সর্বাঙ্গের চাপাহলুদ পেলবতা ধুয়ে-মুছে গেছে। শ্যামাঙ্গী। কুৎসিত। চোখের ড্রপে নেত্রকোণের সেই মন-মাতানো লালিমার আভা কেটে গেছে। দাঁতের নিখুঁত প্লাস্টার-পালিশ উঠেছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে অধর-কোণের কামনা জাগানো তিলটাও।