তবু কিন্তু চেষ্টার কসুর হয়নি।
চায়ের নেমন্তন্ন, সিনেমার আমন্ত্রণ, পিকনিক পার্টির আহ্বান–এমনি অনেক কিছুর সাদর এবং সাগ্রহ আকুতি সলজ্জ বিব্রত মুখে একের পর এক প্রত্যাখ্যাত করেছে। স্বপ্না বোস। খুব যে একটা জোরালো কারণ দেখাতে পেরেছে এমন নয়। পারেননি। বলে বিব্রত হয়েছে, লজ্জিত হয়েছে আরো বেশি। নিরুপায় হয়ে রূপ-রসিকের দল। যুগ্ম আহ্বান জানিয়েছে ওদের। ভাটনগর খুশিতে ডগমগ। পারলে তক্ষুনি আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ছোটে। হাঁক-ডাক করে স্বপ্না বোসকে ডেকে সুসংবাদ শোনায়।
জবাবে আবার সেই কটাক্ষ-বাণ। ভ্রূকুটি করে স্বপ্না বোস শেষে এমন একটা কিছুর ওজর দেখায়, যাতে করে আমন্ত্রণকারীদের সামনেই ভাটনগরের সকল উৎসাহে যেন ঠাণ্ডা জল পড়ে একপ্রস্থ। বলে, অমুক জায়গার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভুলে বসে আছ এরই মধ্যে?
বলে, মিস্টার আর মিসেস অ্যাডভানিকে কি কথা দিলে যে সেদিন?
বলে, সেদিন আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে বলে নাকে খত দিয়েছিলে?
অথবা কিছু না বলে একেবারে হতাশার দৃষ্টিতে শুধু চেয়েই থাকে, যার অর্থ –এমন লোককে নিয়ে তো আর পারিনে!
ভাটনগরের তাতেই পূর্ব কোন প্রতিশ্রুতি বা তেমনি কিছু একটা মনে পড়ে যায়। মাথা চুলকে বিব্রত মুখে মাপ চায় আমন্ত্রণকারীদের কাছে।
এই কবছরে সকলেই সখেদে উপলব্ধি করেছে, বিউটি হাউসের এই তিন ঘন্টা ছাড়া স্বপ্না বোসের মনের আঙ্গিনায় আর পলকের ঠাই হবে না কারো। কিন্তু স্বপ্না বোস যাদু জানে। এই তিন ঘণ্টার সপ্রগম্ভ সান্নিধ্য-প্রাচুর্যের মোহও ভক্তজনেরা কাটিয়ে উঠতে পারে না শেষ পর্যন্ত। পারতে চায়ও না। কিন্তু এর পরে কোথায় থাকে স্বপ্না বোস, কোন জগতে তার গতিবিধি, তার অবকাশকালের কতটা দখল করে আছে ভাটনগর–এসব প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসার জবাব মেলেনি কিছু। মিলেছে এক টুকরো হাসি, এক লাইন কাব্য বা একটু কিছু হেঁয়ালি। শেষ পর্যন্ত ভাটনগরের ভাগ্যের ওপর ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছেড়ে কৌতূহলে ক্ষান্ত দিয়েছে সকলেই।
বিউটি হাউসের আর এক বিপরীত আকর্ষণ ভূতনাথবাবু।
ভূতের যিনি নাথ তিনি আর যাই হোন, নিজে ভূত নন। কিন্তু এ ভূতনাথের নামের সার্থকতা ষোলকলায় পূর্ণ। হল এর একটা কোণের দিকে ছোট টেবিল পেতে বসে একমনে একের পর এক ক্যাশমেমো কাটে। টাকা লেনদেনের জন্য আলাদা ক্যাশ কাউন্টার আছে। যে যাই কিনুক, সেলসম্যান অথবা সেগার্লকে মাল নিয়ে আগে ওর টেবিলে ফেলতে হবে। এই তিন ঘণ্টায় মুখ তোলার অবকাশ থাকে না বেচারীর। তবু এরই মধ্যে ওকে নিয়ে প্রায়ই একটু-আধটু হাস্য-কৌতুকের প্রহসন ঘটে যায়।
মানুষটার চেহারার মধ্যে যেন বেপরোয়া কারুকার্য চালিয়ে গেছেন বিধাতা। গায়ের রঙ আবলুস কাঠকে হার মানায়। ছোট ছোট চোখ দুটোয় এতটুকু জীবনের সাড়া নেই- একেবারে নিরাসক্ত, নিষ্প্রাণ। নাকটা হঠাৎ যেন সামনের দিকে তুবড়ে গেছে। পুরু ঠোঁট, প্রকাণ্ড মাথা আর মাথাবোঝাই অবিন্যস্ত কোকড়ানো চুল। গায়ের রঙে চুলের রঙে মিশে গেছে। চোখধাঁধানো বিউটি হাউসের ঝকমকানি একাই যেন ব্যালান্স করেছে ভূতনাথ। ভাটনগরের রসজ্ঞানের তারিফ করে খদ্দের বন্ধুরা। সেলসম্যান, সেৰ্গার্লরা একতরফাই হাসি-তামাসা করে ভূতনাথের সঙ্গে। একতরফা কারণ, ভূতনাথ কোন কথার জবাব দেয় না, মুখ তুলে মড়া-চোখে তাকায় একবার, মাথা নিচু করে মেমো কাটায় মন দেয় আবার।
ওর সঙ্গে স্বপ্না বোসের অন্তরঙ্গতাটুকু সব থেকে বেশি উপভোগ্য। এ অন্তরঙ্গতাও একতরফাই। অর্থাৎ স্বপ্না বোসের তরফ থেকে। ভূতনাথকে নিয়ে কেউ কিছু বললেই সে প্রতিবাদ জানায় তৎক্ষণাৎ বলে, রাহু ছাড়া চাঁদ মানায় না, ভূতনাথ ছাড়া বিউটি হাউস মানায় না। মেমো লেখাতে গিয়ে হাল্কা চাপল্যে তার মাথার ওই ঝাকড়া চুলের মুঠি ধরে দুই-একবার ঝাঁকুনি দেওয়াটা প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ওর।
কোন রসিক ভক্ত ঠাট্টা করে।–এও যেন রাহুর সঙ্গে চাঁদের মিতালি!
মুচকি হেসে স্বপ্না বোস জবাব দেয়, একমাত্র রাহু ছাড়া চাঁদের কাছে আর ঠাই। কার?
মাঝে মাঝে আরো বেশ খানিকটা গড়ায়। এখানকার সর্বজনজ্ঞাত একটা বড় তামাসার কথা হল যে, ভূতনাথবাবু নাকি স্বপ্না বোসের প্রেমে পড়েছে। কার মাথায় যে প্রথম এই রসিকতাটুকু এসেছিল, সে আর কারো মনে নেই। কিন্তু কথাটা থেকে গেছে। কালোর সঙ্গে আলো মেশে না বলেই হয়ত এ ধরণের রসিকতা জমে ভালো। ভাটনগরও সানন্দে যোগ দেয় এসব হাসি-ঠাট্টায়।
স্বপ্না বোস হয়ত বলে, মিথ্যে ওকে দোষ দেওয়া কেন, আমিই বরং ওর প্রেমে পড়ে গেছি!
শোনামাত্র ভাটনগরকে সচেতন করে দিতে চায় কেউ, বলে, সাবধান ভাটনগরজী, ওই ভূত বাবাজীই কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন আপনার ঘাড় থেকে
মনোমত কথাটা আর হাতড়ে পায় না।
স্বপ্না বোস আলতো করে জুড়ে দেয়, পেত্নী ছাড়াবে!
সমস্বরে হেসে ওঠে সকলে। ভাটনগর একবার সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দূরে কর্মরত মূর্তিটির দিকে। বলে, ভূতনাথ ইজ এ জুয়েল–এ ব্ল্যাক জুয়েল-রত্নের প্রতি আর লোভ না থাকে কোন মেয়ের!– তবু মুখে যে যত হাসি-তামাশাই করুক, একমাত্র ভাটনগর ছাড়া স্বপ্না বোসকে যখন-তখন তরল হাস্যে ওই ভূতনাথের গায়ে-পিঠে হাত বুলোতে দেখে বা ঝাকড়া চুলের গোছায় বেপরোয়া চাপাকলি আঙুল চালাতে দেখে বুকের ভেতরটা চড়চড় করে ওঠে অনেকেরই।