আশ্চর্য, মেয়েদের সঙ্গে পর্যন্ত ভারি সহজ একটা হৃদ্যতা ওর যা হবার কথা নয়। তারা আসে রূপচয়ন করতে। এ নারী রূপেরই জীবন্ত উৎস। ঈর্ষা হবার কথা, কিন্তু হয় না। বরং সলা-পরামর্শ নির্দেশ-উপদেশের জন্য ওরই কাছে মন খুলে দেয়। তারা। ওকে দেখে আপন অভিলাষ ব্যক্ত করতে নবাগতদের হয়ত একটু সঙ্কোচ হয়, হয়ত বা ওর দিকে চেয়ে চেয়ে চাপা নিঃশ্বাসও পড়ে দুই-একটা। কিন্তু যাদু জানে স্বপ্না বোস। হেসে, জড়িয়ে ধরে, কানে কানে কথা বলে, নিরিবিলি চেম্বারে টেনে নিয়ে গিয়ে মনের কথা শুনে আর মনের মত কথা শুনিয়ে বৈষম্যের অনুভূতিটুকু পর্যন্ত ধুয়ে-মুছে দেয়।
পুরুষদের সঙ্গে অবশ্য স্বপ্না বোসের রীতিনীতি ভিন্ন। এদের মধ্যে সমস্যা নিয়ে যারা আসে, তারা আর যাই হোক ওর কাছে আসে না। তারা সোজা যায় ভাটনগরের কাছে, নয়ত তার অন্য কোনো পুরুষ সহকারীর কাছে। কিন্তু স্বপ্না বোসের সঙ্গ অভিলাষী আগন্তুকের সংখ্যাও কম নয়। বারো মাস তিরিশ দিনের প্রসাধনসামগ্রীই হয়ত কিনতে আসে তারা। একের জায়গায় তিন গছিয়ে দেয় স্বপ্না বোস। কৃত্রিম বিপন্ন ভাবটি ফুটিয়ে তুলে তারা হয়ত বলে, বাঃ রে, এত কি হবে?
নিয়ে যান, বউ খুশি হবে।
বউ খুশি হোক না হোক, আর কেউ যে খুশি হবে সেটা জেনেই ওরা খুশি।
কাউকে বা স্বপ্না বোস ছদ্মকোপে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, আপনারা না নিলে আমাদের দোকান চলে কি করে?
ওদের দোকান সচল রাখতে গিয়ে নিজে অচল হচ্ছে কিনা, সেটা তখনকার মত অন্তত অনেকেরই মনে থাকে না।
বাড়িগাড়িঅলা সুপরিচিতদের ছদ্ম-ত্রাস-জড়িত অন্তরঙ্গতার সুরও বৈচিত্র্যহীন নয়।–বাঃ রে, এলেই এককাঁড়ি জিনিস নিতে হবে তার কি মনে আছে? গরীব মানুষ, অত টাকা কোথায় পাব?
স্বপ্না বোস কখনো একঝলক হেসে ফস করে জবাব দেয়, তবে দোকানে আসেন। কেন? কখনো বা তেমনি ছদ্ম-গাম্ভীর্যে বলে, সত্যি কথাই তো, টাকার এত টানাটানি আপনার–আচ্ছা নিয়ে যান, জিনিসগুলো আমার নামে লিখিয়ে রাখবখন।
সানন্দে হার মেনে জিনিস নেয় তারা।
হল-এর এক প্রান্তে ভিজিটাদের জন্য দামী সোফা সেটি কৌচ পাতা। অন্তরঙ্গজনদের নিয়ে সেখানে দিব্বি আড্ডা জমে যায়। প্রায়ই চা আসে, সিগারেট আসে। ভাটনগরের সেদিকে একটুও কার্পণ্য নেই। সপ্রগম্ভ আড্ডার মাঝেই স্বপ্না বোস এক এক সময়ে সকলকে সচেতন করে দেয়। বেচারী ভাটনগর ভ্যাব-ড্যাব করে দেখছে দেখুন, আপনাদের ব্যাপার দেখে-হার্টফেল না করে বসে।
জোড়া জোড়া চোখ ছোটে অদূরে মালিকের দিকে। দুহাত তুলে ভাটনগর একটা হতাশার ভাব দেখায়। কখনো বা স্বপ্না বোসের দিকে চেয়ে হাসে মৃদু-মৃদু। আবেশ জড়ানো হাসি। আর এদিক থেকে সে হাসির নীরব প্রত্যুত্তরও বোধ করি সবারই চোখে পড়ে। বুকের ভেতরটা খচখচ করে ওটে অনেকেরই। কিন্তু ভাটনগরের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব নয় কোনমতে, এও এতদিনে সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। অবাঙ্গালী ভাটনগরের ভাগ্য দেখে তারা ঈর্ষা করাও ছেড়ে দিয়েছে। এখন সেটা সরস হাস্য-কৌতুকের ব্যাপার।
স্বপ্না বোস শত্রুমুখে রসালাপের ছোট্ট বড়েটা এগিয়ে দেয় যেন। চাকরিটা আমার আপনারাই খাবেন দেখছি!
হাঁ-হাঁ করে ওঠে তারা।–নিশ্চয় খাবো, আলবৎ খাবো, কবে খাবো বলুন ভাটনগর চাকরি খেতে দেরি করছে বলেই তো আমাদের অমন খাওয়াটা মাটি!
বলে বটে। কিন্তু ভাটনগর সত্যিই যদি তার চাকরি খেয়ে এদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করে, বিউটি হাউস দুদিনেই তাহলে মরুভূমি হয়ে যাবে এও বোঝে। খাওয়া তাদের একদিন জুটবেই, তবে ভাটনগরের গৃহস্বামিনী হলেও শুধুই ঘরের বউ হয়ে থেকে স্বপ্না বোস ব্যবসা মাটি করবে না, এটুকুই ভরসা।
অবকাশকালে ভাটনগরও সহাস্য বদনে এদের হালকা ফুর্তিতে যোগ দেয়। বিভিন্ন পেশার লোক আছে স্তাবকদলের গুঞ্জন-সভায়। ভাটনগর ডাক্তারকে লক্ষ্য করে বলে, একবার স্টেথসকোপটা লাগান দেখি বুকে, ঠিক চলছে কিনা দেখি! কখনো বা নব্য ব্যারিস্টারের উদ্দেশে বলে, আপনি রেডি থাকুন স্যর, ওর এগেইনসট-এ হয়ত শীগগিরই কেইস ঠুকতে হবে! ওর মানে স্বপ্না বোসের। কখনো বা অসহায় মুখে প্রোফেসার নামখ্যাত লোকটির স্মরণ নেয়। কিসের প্রোফেসার, কোথাকার প্রোফেসার জানে না (জানে না বোধ হয় কেউ-ই), তবু বলে, আপনার কাছে আমি দর্শন পড়ব প্রোফেসার-এ জীবনে আর কি সুখ!
হাসাহাসি পড়ে যায়। স্বপ্না বোসের পাশের জায়গাটা আপনিই খালি হয়ে যায়! জায়গাটা কে ছেড়ে দিলে ভালো করে খেয়াল না করেই ওর গা-ঘেঁষে বসে পড়ে ভাটনগর। স্বপ্না বোস তাকায় আড়চোখে। সে কটাক্ষ-বাণে ভাটনগর কতটা বিদ্ধ হয় বলা শক্ত। কিন্তু আর যারা বসে, তাদের দৃষ্টিপথে সে কটাক্ষ একেবারে মর্মে গিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে থাকে। হাসি-বিদ্যুৎ-প্রেম–এ তিনের একখানি ঝকঝকে ছুরি যেন। চোখের দুকোণে একটু লালিমা, চোখের তারার তড়িত-ঝলক আর চোখের গভীরে কাজল-দীঘির নিবিড়তা। আঁখি-কোণের ওই লালিমা অবশ্য তারা যখন-তখন দেখে দেখে পাগল হয়। কিন্তু এই তিনের ট্রায়ো সব সময়ে বড় চোখে পড়ে না।
আর, এই দৃষ্টি-মাধুর্য দর্শন থেকেই হয়ত সকলে এরা মনে মনে উপলব্ধি করেছিল, ভাটনগরের কাছ থেকে স্বপ্না বোসকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা স্বপ্নের মতই ব্যর্থ হবে। কারণ মানুষটা তার এই বিচিত্র আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই এই নারীর প্রসন্নতার শতকরা সবটুকুই দখল করে বসে আছে।