.
এই পর্যন্তই চিত্র।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। নিস্পন্দের মত বসে আছেন তিনি, কিন্তু পরক্ষণেই হতভম্ব আমি। হঠাৎ সরোষে মা বলে উঠলেন ওই সুমিত্রার ওপরে তুমি পক্ষপাতিত্ব করেছ–তার ভিতরে অনেক বিষ ছিল–স্বামীর স্ট্রোক হবার পরে ছেলেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে সেও মনে মনে চাইছিল স্বামী উইল করে দিয়ে যাক–জানো?
তীক্ষ্ণ শোনালো কণ্ঠস্বর। এমন মহীয়সী যিনি, এত তেজ আর এত ক্ষমা যাঁর মধ্যে, তাঁর এই রূঢ়তা আমি আশা করিনি। আঘাতই পেলাম যেন। বললাম, আপনি নিশ্চয়ই রণদাবাবুর মুখে শুনেছেন এ-কথা, কিন্তু পুরোপুরি সত্যি তো না-ও হতে পারে…।
মা নীরব একটু। নিজেকে সংযত করলেন। শান্ত কমনীয় আবার। একটু থেমে নিয়ে বললেন, গল্প মোটামুটি ঠিকই হয়েছে। কেবল তোমার ভাবনায় সামান্য একটু ভুল থেকে গেছে।
আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে আছি।
তেমনি সহজ সুরেই তিনি আবার বললেন, আমি মনোরমা নই। সে ভাগ্যবতী সিথির সিঁদুর নিয়েই চোখ বুজেছে। আমি সুমিত্রা। আমি নির্বাক বিমূঢ় নিস্পন্দ কাঠ।
তিলে তিলে তিলোত্তমা
আজব শহরের আজব বাহার!
ঘড়ি ধরে সন্ধ্যা ছটায় খোলে, নটায় বন্ধ হয়। আশেপাশে প্রায় সকাল ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত যাদের দোকান খোলা, তারাও তখন ওদিকপানে চেয়ে থাকে আর বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রাসাদোপম এই অট্টালিকায় অনেক ব্যবসায়ী অনেক রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। কিন্তু বিউটি হাউসের তিন ঘণ্টা ওদের তিরিশ ঘণ্টা।
সব রাস্তা রোমের দিকে। এখানে সব আগন্তুক বিউটি হাউসের দিকে। সসঙ্গিনী তিনঘণ্টা সিনেমায় কাটানো যায়, লাভার্স পার্কের আবছা আলোয় নিরিবিলিতে বসে তিন মিনিটে তিন ঘণ্টার অবসান হতে পারে, হাত-ধরাধরি করে শিথিল চরণে মার্কেট প্লেসের শো-কেইস দেখেও ঘণ্টাতিনেক উতরে দেওয়া যায়। কিন্তু এখানকার এই তিন ঘণ্টার স্রোত একেবারে অন্য খাতে বইছে। এই তিন ঘণ্টায় মনো-বৈচিত্র্যের নিখুঁত নক্সা আঁকতে পারে, এমন লিপি-বণিক জম্মায়নি বোধ হয়।
রূপচর্যার জীবন্ত মিছিল। বিধাতার মার হার মেনেছে বিউটি হাউসের মার প্যাঁচের কাছে। খোদার ওপর খোদকারীর নমুনা দেখাচ্ছে বিউটি হাউস। বিউটি হাউস মুশকিল-আসান।
নারীপুরুষের বিচ্ছিন্ন সমাগম। সঙ্গী বা সঙ্গিনী নিয়ে বড় কেউ আসে না এখানে। অন্যের চোখে নিজেকে অভিরাম করে ভোলার তাগিদে কোঅপারেশন অচল।
প্রকাণ্ড হল। শাদা আলোয় মেঝেতে পুরু কার্পেটের রোঁয়া পর্যন্ত দেখা যায়। একদিকে সারি সারি শো-কেইসএ রঙ-বেরঙের প্রসাধনসামগ্রী সাজানো। সেসবের উপযোগিতা আর ব্যবহার বুঝিয়ে দেবার জন্য আছে এক্সপার্ট সেলসম্যান। অন্যদিকে ছোট ছোট চেম্বার। হাতে-কলমে কলাকৌশল শেখানোর মহড়া চলেছে সেখানে।
বয়সের ভারে কোঁচকানো চামড়ায় যৌবনের জলুস আনা যেতে পারে।…কালোর চেকনাই ছোটানো যেতে পারে শাদা চুলে।…তোবড়ানো গাল ভরাট দেখাবার উপকরণ পেতে হলে এখানে আসতে হবে। …এখানে আসতে হবে প্লাস্টার-পালিশে বাঁকাচোরা বিকৃত দাঁতে কুন্দ-দন্তের শোভা আনার কৌশলটি জানতে হলে। পটলচেরা চোখ বা কোকড়ানো চুল চাই তো এসো বিউটি হাউসে।–শুধু এখানকার উপকরণ আর পনের দিনের ট্রেনিং-এর পরে মুখের ওপর সার্চলাইট ফেললে প্রসাধন যদিও বা ধরা পড়ে, আসল রঙটি ধরা যাবে না। শোনা যায়, এ বিদ্যে শেখানোর জন্য প্যারিস থেকে ট্রেইনার ধরে এনেছে দোকানের মালিক ভাটনগর। নিরুৎসুক-জনের খটকা লাগতে পারে, যে-দেশে কালো রঙের সমস্যা নেই, সে-দেশে অমন এক্সপার্ট গজায় কি করে? কিন্তু নিরুৎসুক-জনকে নিয়ে কারবার নয় বিউটি হাউসের।
চটপটে ছটফটে মানুষ ভাটনগর। হাসছে গল্প করছে তদবির-তরক করছে। নতুন খদ্দের দেখলেই বিলিতি কায়দায় মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানায়, সাদরে নিয়ে গিয়ে বসায় নিজের নিরিবিলি বসবার জায়গাটিতে। গভীর সহানুভূতিতে সমস্যা শোনে, মাথা নাড়ে। সম্ভাব্য সমাধান বাতলে দিয়ে আশ্বস্ত করে তারপর। সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের গায়ে লাগানো বোতাম টেপে। প্যাক করে শব্দ হয় একটা। বেয়ারা দৌড়ে আসে।
–সাবকো (অথবা মেমসাবকো ) …নম্বর কামরা দেখাও।
পুরানো বা চেনা-জানা খদ্দেরের সঙ্গে তার হাসি-খুশি-ভরা অন্তরঙ্গতায় ব্যবসায়ীর দূরত্ব নেই এতটুকু। কোনো ভদ্রলোকের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে সোচ্ছাসে বলছে, গ্রোইং ওয়ানডারফুলি ইয়ং স্যার! উত্তরতিরিশ কোনো মহিলাকে সবিনয় অভিবাদনে স্তুতি জানাচ্ছে, ইউ লুক হার্ডলি টুয়েন্টি মাদা!
যার রূপ আছে সেও আসে। যতটুকু আছে তার থেকে বেশি একটু থাকতে আপত্তি কি! আর যার নেই তার তো কথাই নেই। কিন্তু সবাই যে এখানে এসে একেবারে রূপচয়নে বসে যায় বা তেমনি কোন সমস্যা নিয়ে হাজির হয় এমন নয়। সাধারণ প্রসাধনসম্ভারও হরদম বিক্রি হচ্ছে এখানে, যা আজকাল ঘরে ঘরে লাগে। সেব কেনার ছুতোয় কৌতূহল মেটাতে আসে অনেকে।
কিন্তু আরো একটা আকর্ষণ আছে বিউটি হাউসের।
স্বপ্না বোস।
দীপশিখা যেমন পতঙ্গ টানে, তেমনি ওরও অমোঘ একটা আকর্ষণ আছে। পিছনের দরজা দিয়ে গটগট করে ঢোকে যখন, মনে হয় এত বড় হল্টা ঝলমলিয়ে হেসে উঠল।
বিউটি হাউসের প্রধান আপ্যায়িকা স্বপ্না বোস।
কিন্তু অন্তরঙ্গ সকলেরই বিশ্বাস, শুধু কর্মচারিণী নয়, ব্যবসায়ের কলকাঠিও এই মহিলাই আগলে বসে আছে। আর ধারণা, স্বপ্না বোস ছাড়া ভাটনগরের জীবন জোয়ারেও চড়চড় করে ভাটা নেমে আসবে। অনেকের ইঙ্গিত আরো স্পষ্ট। বোস পদবীটা এখনো রেখেছে ব্যবসায়ের আবহাওয়ায় রোমান্স ছড়াবার জন্য, নইলে, ইত্যাদি।