প্রেমানন্দ ঘোষ অবাক।-না তো, আসাম থেকে কে আসবে?
–একটি ছেলে, এলে শুনো। তাড়া আছে, চলি।
চলে গেলেন। শুধু প্রেমানন্দ নয়, সুমিত্রাও বিস্মিত।
পরদিন। প্রেমানন্দ শুয়ে, তার সামনে বসে বেদানা ছাড়াচ্ছেন সুমিত্রা। বুড়ো চাকর এসে খবর দিল, সাহেবপানা একটি ছেলে কর্তাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান, বললেন, আসাম থেকে আসছেন–অসুখের জন্যেই দেখা করা বিশেষ দরকার।
প্রেমানন্দ ঘোষ ভেবে পাচ্ছেন না কে হতে পারে? অসুখের খবর রণদার কাছে জেনে থাকবে। বললেন, নিয়ে এসো
সুমিত্রা চলে গেলেন না অথবা যেতে পারলেন না। তাছাড়া বাড়ির কর্তার ঘরে একলা থাকা নিষেধ, আর বাইরের কেউ এলে বেশি কথা বলাও নিষেধ। চাকরের কথায় মনে হয়েছে- অল্পবয়সীই কেউ হবে।
যিনি এলেন তাকে দেখে ঘরের দুজনেই একটু বিশেষ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলেন। হাজারের মধ্যে এরকম, চেহারা বড় দেখা যায় না। আর সাহেবপানাই বটে। তাকে দেখামাত্র প্রেমানন্দ ঘোষ কেমন বিমূঢ় যেন।
আগন্তুকের হাতে বড় চামড়ার ব্যাগ একটা। পরনে ট্রাউজার আর চকচকে হাফ শার্ট। তাতেই রূপ ঠিকরে পড়ছে। ব্যাগসুষ্ঠু হাত তুলে ঘরের দুজনের উদ্দেশেই নমস্কার জানালেন।
প্রেমানন্দ ঘোষ ইঙ্গিতে সামনের খালি চেয়ারটা দেখালেন।
চেয়ারে বসে হাতের মোটা ব্যাগের খুপরি থেকে ছোট্ট একটা মোড়ক বার করে আগন্তুক বললে, এতে একটা কবচ আছে, আপনার অসুখ জেনে আমার মা আপনাকে পরার জন্য বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন।
প্রেমানন্দ এবং সুমিত্রা দুজনেই হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার…মানে তোমার মা আমার অসুখ জানলেন কি করে?
–মাস দুই আগে রণদা কাকার সঙ্গে দেখা করতে এসে আমিই শুনে গিয়ে। বলেছিলাম। মায়ের বিশ্বাস, এটা পরলে আপনার উপকার হবে।
-তা তোমার নাম কি বাবা?
–আমার নাম মহানন্দ ঘোষ।
কোন দুর্বোধ্য কারণে প্রেমানন্দ আর সুমিত্রা দুজনেই কি চমকে উঠলেন একটু?
সুমিত্রা চেয়েই আছেন ছেলেটির দিকে। তার কাছে ছেলের বয়সীই, বছর পঁচিশ ছাব্বিশ হবে বয়েস।
আত্মস্থ হয়ে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, রণদার সঙ্গে তোমাদের কতদিনের পরিচয়?
আমি গেলবারেই প্রথম দেখলাম।..বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার ব্যাপারে তার তদবির-তদারকে কোনরকম সুবিধে হয় কিনা, আলাপ করতে এসেছিলাম। আমার বাবার বিশেষ বন্ধু তিনি।
–তোমার বাবার নাম কি?
খুব ধীর স্পষ্ট জবাব এলো, আমার বাবার নাম প্রেমানন্দ ঘোষ।
আকাশ থেকে বাজ পড়ল একটা? নাকি সুমিত্রা আর প্রেমানন্দ দুজনেই স্বপ্ন দেখছেন? নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম প্রেমানন্দর। এত উত্তেজনা ভাল নয়। কিন্তু দুজনের কারোই তা খেয়াল থাকল না, খেয়াল শুধু মহানন্দ করলেন। বললেন, আপনি উত্তেজিত হতে পারেন ভেবে মা আমাকে আসতে দেবেন কিনা ভাবছিলেন।
প্রেমানন্দর গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না প্রায়। বিমূঢ় মুখে বললেন, কিন্তু তিনি তো পঁচিশ বছর আগে মারা গেছেন!
মারা যাননি। আপনি যা চেয়েছিলেন টেলিগ্রামে তাই শুধু জানিয়েছেন।
স্তব্ধ মুহূর্ত অনেকগুলো। প্রেমানন্দ ঘোষের নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক সক্রিয় হতে লাগল খুব আস্তে আস্তে। দু চোখের সমস্ত দৃষ্টি ঢেলে লক্ষ্য করছেন। …ভাওতা নয়, হতে পারে। চেহারাই বলছে, হতে পারে। মায়ের মুখের আদল কি নিজের মুখের, জানেন না–কিছু একটা বড় বেশি স্পষ্ট। কিন্তু পঁচিশ বছর বাদে আজ হঠাৎ এই কবচ পাঠানো কেন? অসুখ বলে?…নাকি রণদার কাছে সঙ্কটের সময় উপস্থিত শুনে ছেলের জন্য কোনো সংগতির ব্যবস্থা চায়? ছেলেকে বিলেত পাঠিয়ে ব্যারিস্টার করে আনার উদ্দেশ্যও হতে পারে। অনেককাল ধরে আইন আর কোর্ট করে মানবচরিত্রের দুর্বলতা কিছু বেশিই জেনেছেন তিনি।
অপেক্ষা করছেন। চেয়ে আছেন।
মহানন্দ ঘোষ বললেন, বেশি বিরক্ত করব না, আর একটু কাজ সেরেই আমি যাব
বড় চামড়ার ব্যাগ খুলে মস্ত একটা প্যাকেট বার করে তার সামনে রাখলেন। –এতে আপনার সব গয়না আছে, মা স্কুলে মাস্টারি করে আমাকে মানুষ করেছেন, এর একটাও খরচ হয়নি। দিয়ে গেলাম—
বুকের ঠিক মধ্যিখানে প্রচণ্ড একটা আঘাত এসে লাগল যেন। সুমিত্রা মূর্তির মত বসে। প্রেমানন্দ ঘোষ ঘামছেন। পরক্ষণে উঠে বসতে চেষ্টা করে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
–এগুলো তোমার মা তোমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
-হ্যাঁ, এগুলোর জন্যে আপনি চিঠি লিখেছিলেন। মা তখন রাগ করেই দেননি। বোধ হয়।
-তা বলে আজ–আজ এই প্রতিশোধ নিল! প্রতিশোধ নেবার জন্য তোমাকে দিয়ে এগুলো পাঠাতে পারল!
সুমিত্রা তাড়াতাড়ি ধরে শুইয়ে দিলেন তাকে। প্রেমানন্দ ঘোষ কাঁপছেন থরথর।
একটু চুপ করে থেকে মহানন্দ বললেন, তিনি ঠিক পাঠাননি, তার ইচ্ছে বুঝে আমিই নিয়ে এসেছি। মায়ের কাছে এত গয়না দেখে আমি ভেবেছিলাম আমার জন্যেই রেখেছেন। বিলেত যাবার জন্য এগুলো চেয়েছিলাম। মা তখন বলেছেন ওগুলো। আপনার, আপনাকে ফেরৎ দেবেন বলে রেখেছেন। সব শোনার পরেও পাছে আবার আমার লোভ হয়, তাই এবারে আসার সময় নিয়ে এলাম।
আর কিছু বলার বা শোনার জন্য অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালেন মহানন্দ ঘোষ।এরপর আপনার আরো ক্ষতি হতে পারে, আচ্ছা চলি—
লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরের বাইরে চলে এলেন তিনি। কিন্তু বাইরে এসেও প্রেমানন্দর আর্তস্বর শুনলেন। স্ত্রীকে বলছেন! দেখলে ব? শুনলে সব? এসব গয়না এখন তুমি নাও, তুমি দেখো, ছেলেদের দেখাও–খুব খুশী হবে, আমার শুধু এই কবচ থাক–বুঝলে? বুঝলে?