প্রেমানন্দ বলেছেন, তাহলে বিয়ে হবে না, তারা রাজী হবেন না।
অন্য কেউ হলে আপত্তি করতেন, কিন্তু দ্বিজেন গাঙ্গুলি সেই চরিত্রের মানুষ যিনি অন্য কারো মতামত বা অনুমোদনের গুরুত্ব দেন না। তিনি শুধু জিজ্ঞাসা করেছেন, প্রেমানন্দ মেয়ের সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন কিনা। আর বিয়ে করলে আর কিছু যে প্রাপ্তির আশা নেই তাও তিনি স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
উকীলের ছেলে প্রেমানন্দ টাকা চেনেন, টাকার প্রতি তার টানও আছে। কিন্তু তখন সমস্ত চিন্তা তার একটাই। বলেছেন, আর কিছু তিনি আশা করেন না।
বিয়ে হয়ে গেল। এমন অনাড়ম্বর বিয়ে প্রেমানন্দ কল্পনাও করতে পারেন না। তবু তখনকার মত আত্মবিহ্বল তিনি।
মনোরমাকে নিয়ে যেদিন কলকাতায় রওনা হবেন, তার আগের দিন রাত্রিতে দ্বিজেন গাঙ্গুলি মানুষটিকে সত্যিই চেনা গেল। মনোরমাকে তিনি আদেশ দিলেন–ভারী কাঠের সিন্দুকটা খুলতে আর তার ভিতরে একটা উবুড় করা বড় হাঁড়ির মধ্যে যে শাড়ি জড়ানো বড় পুটলিটা আছে, সেটা নিয়ে আসতে।
নির্দেশ পালন করা হল। পুঁটলি খুলতেই চক্ষুস্থির প্রেমানন্দ ঘোষের। একরাশ পুরনো ধাঁচের সোনার গয়না।
দ্বিজেন গাঙ্গুলি বললেন, বিশ বছর আগের পঁচিশ হাজার টাকার গয়না এখানে, এখন এর দাম কম করে পঁয়তিরিশ হাজার হবে–খুব সাবধানে নিয়ে যাও!
প্রেমানন্দ হতভম্ব। সত্যি দেখছেন বা সত্যি শুনছেন কিনা সেই সংশয়। দ্বিজেন গাঙ্গুলি আবার বললেন, এসবই ওর, পাছে গয়নার লোভে কেউ ওকে বিয়ে করতে চায় সেজন্যে বলিনি। দেড়মাস বয়সে ওর মা শুধু ওকেই রেখে যায়নি ওর মাথার কাছে এই পুঁটলিটাও রেখে গেছল।
.
কলকাতা।
প্রেমানন্দর বাবা মা বা আত্মীয় পরিজন কেউ এ বিয়ে ক্ষমার চোখে দেখেননি। বউ রূপ্রস্রী সেটা সকলেই দেখেছেন, এমন রূপ সচরাচর চোখে পড়ে না, কিন্তু এই রূপের পিছনে কাটার ছায়াও দেখেছেন সকলে। এমন রূপসী মেয়েকে এভাবে কে গছিয়ে দেয়? যে-লোক ছেলের বাপ-মায়ের অনুমতি না নিয়ে এ-ভাবে মেয়ে পার করল, সেই লোককে ভালো বলা যাবে কেমন করে? আর ভালো না হলে তারই আশ্রয়ে ছিল যখন–এই মেয়েই বা কেমন?
প্রেমানন্দ নিজের বাড়িতে চোরের মত কাটালেন কিছুদিন। উত্তেজনা একটু থিতিয়ে আসতে সব খুলে বলে মা-কে বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি। ফল তাতে আরো বিপরীত হল। মা-টা কেন আত্মহত্যা করল? মায়ের স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? একজন পর-পুরুষের বাড়িতে মেয়ে ফেলে রেখে গেল কেন?
যাক, বাড়ির কর্তা পঁয়তিরিশ হাজার টাকার গয়না পাওয়া গেছে শুনেই হয়ত শেষ পর্যন্ত ত্যজ্যপুত্র করলেন না ছেলেকে। মোট কথা, ওই গয়না ছাড়া আর কিছুই পছন্দ হল না প্রেমানন্দর বাবা-মায়ের।
তবু মনোরমা যতদিন মুখ বুজে ছিলেন, একরকম কেটেছে। মুখ খুলতেই গণ্ডগোল শুরু হল। দুমাস না যেতেই বউয়ের এক-এক সময় উগ্র মূর্তি দেখে বাড়ির মানুষেরা তাজ্জব। অন্যায় কিছু কানে এলে মনোরমা ফুঁসে ওঠেন। আর কানে তো হরদমই আসছে। বউ সহ্য করে না বলে প্রেমানন্দও বিরক্ত। কখনো বা ক্রুদ্ধ। তারও ফল বিপরীত। কাপুরুষের মত স্বামী অত্যাচারের প্রশ্রয় দেয় বলে তার ওপরেও এক এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মনোরমা।
বউয়ের সাহস আর স্পর্ধা দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল শ্বশুর-শাশুড়ীর। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে তারা সাহস দেখেন; স্পর্ধা দেখেন। কথার জবাবে কথা বললে রাগে সাদা হয়ে ওঠেন তারা। আর সবকিছুর অবধারিত গঞ্জনার ঝাঁপটা এসে পড়ে প্রেমানন্দর ওপর। বেচারা নতুন উকীল, পসারের চেষ্টায় মাথা ঘামাবেন কি, বাড়ির অশান্তিতে নাজেহাল। ফলে বউয়ের ওপরেই ক্রোধে আরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি।
এদিকে রণদা চ্যাটার্জী ঘন ঘন বাড়িতে আসেন আজকাল। তার সঙ্গে অমন দেমাকী আর অতি রাগী বউয়ের সম্প্রীতি একটুও সুনজরে দেখেন না শ্বশুর-শাশুড়ী। ওদিকে এই একমাত্র মানুষকে বেশ সমীহ করতে দেখে প্রেমানন্দর নিভৃতের চিন্তাও বিকৃত রাস্তায় চলতে শুরু করল। মনোরমা রাজী হলে জাত-বর্ণের রাধা বা বাপ মায়ের আপত্তি তুচ্ছ করেও বিয়ে করতে আপত্তি ছিল না রণদার, এ তো তার নিজেরই মুখেই শুনেছেন। সামনা-সামনি বন্ধুর সঙ্গে কোনো বিবাদের সূচনা হল না বটে, কিন্তু অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকল।
শেষে তুচ্ছ কারণেই দপ করে জ্বলে উঠল একদিন।
কোন এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে পৈতের নেমন্তন্ন ছিল সকলের। প্রেমানন্দ সকালে উঠেই সেখানে চলে গেছেন। বউকে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীরও সকাল-সকালই যাওয়ার কথা। কিন্তু মনোরমা জানালেন, তাঁর শরীর ভালো না, তিনি যাবেন না।
বউ সাত মাস অন্তঃসত্ত্বা, শরীর ভালো নাও থাকতে পারে, শ্বশুর-শাশুড়ী তার আপত্তিতে কান দিতে চাইলেন না। হুকুম করলেন, যেতে হবে। মনোরমা শাশুড়ীকে জানালেন তার যাওয়া সম্ভব হবে না।
ছুটির দিন। এর একটু বাদে রণদা এলেন গল্প করতে। শ্বশুর-শাশুড়ী দেখলেন বউ তার সঙ্গে দিব্বি কথাবার্তা কইছে।
নেমন্তন্ন বাড়িতে এসে ছেলেকে ডেকে তার বাবা নিজেদের অপমানের ফিরিস্তি দিলেন, আর রণদার সঙ্গে বসে বউ গপ্পসপ্প করছে জানিয়ে তাকে বললেন বউকে নিয়ে আসতে।
মাথার মধ্যে অগ্নিকাণ্ড শুরু হল প্রেমানন্দর। ট্যাক্সি হাঁকিয়েই বাড়ি ফিরলেন তিনি। এসে অবশ্য দেখেন বউ একাই আছে। তবু যা মুখে আসে তাই বলে গালাগালি করলেন। রণদাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হবে না, একথাও ঘোষণা করলেন। আর বিয়ের নমাসের মধ্যে জীবনটা যে তাঁর অশান্তিতে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেল সরোষে তাও বার বার বলতে বাকি রাখলেন না।