দ্বিজেন গাঙ্গুলি প্রেমানন্দ ঘোষের নামধাম লেখাপড়া ইত্যাদির খোঁজখবর নিলেন। প্রেমানন্দকে লক্ষ্যও করলেন ভালো করে। লক্ষ্য অনেকেই করে থাকে, অমন সুন্দর চেহারা শতেকে চোখে পড়ে না। যেমন গায়ের রঙ, তেমনি উঁচু লম্বা, তেমনি স্বাস্থ্য। দেখে দুচোখ হঠাৎ চকচক করে উঠল দ্বিজেন গাঙ্গুলির। এরপর বার কয়েক মেয়েকে তিনি ঘরে ডাকলেন–চা-জলখাবার দেবার জন্য, পেয়ালা নিয়ে যাবার জন্য, মশলা দিয়ে যাবার জন্য।
তারপর রণদার উদ্দেশে অনুযোগ করলেন, আমাকে একটি ভালো ছেলে দেবার জন্য কলকাতায় তোমাকে চিঠি পর্যন্ত লিখেছি, কিছুই তো করলে না, এদিকে আমার এই হাল, কবে আছি কবে নেই, আর সুযোগ পেয়ে বাজে লোকে হামলাও করে, দুর্ভাবনায় আমি ঘুমুতে পারি না জানো?
বাড়ি থেকে বেরিয়েই রণদা চাটুজ্যে প্রেমানন্দর জেরায় পড়লেন।-মেয়ের জন্য ভদ্রলোক আসলে তোমাকেই চান বোধ হয়?
-না।
–কেন? তুমি দুর্লভ?
–না, ওই মেয়ে আমার দুর্লভ। মেয়ে রাজী হলে সকলের অমতেই বিয়ে করতুম।
–আশ্চর্য! মেয়ে রাজী নয়?
-প্রস্তাব দিইনি কখনো, দিলেও রাজী হবে না। মেয়ের দোষের মধ্যে মেজাজ কড়া।
–কেন রাজী হবে না কেন, তুমি যোগ্য নও?
-একটু বেশি যোগ্য বলে। মনোরমা বামুনের মেয়ে নয়, কায়স্থ। তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তো বলো, দ্বিজেন কাকা আকাশের চাঁদ হাতে পাবেন।
প্রেমানন্দ ঘোষের হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিল বুঝি। স্তব্ধ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, মেয়েটি তাহলে তোমার দ্বিজেন কাকার মেয়ে নয় বলছ?
-না। তবে মেয়ের থেকে ঢের বেশি।
রণদা চ্যাটার্জী এরপর খোলাখুলিই বলেছেন সব। কারণ তিনি অনুমান করেছেন মনোরমার রূপ দেখে বন্ধুর মাথা ঘুরেছে, আবার বন্ধুর রূপ দেখে ওদেরও মাথা ঘোরা বিচিত্র নয়। নইলে গাঙ্গুলি কাকা অত আগ্রহ নিয়ে খোঁজখবর করছিলেন কেন?
যা তিনি নিবেদন করলেন, তার ইতিবৃত্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু জটিল একটু। বয়েস কালে দ্বিজেন গাঙ্গুলি ভয়ানক বেপরোয়া ছিলেন আর তার চরিত্রেরও দুর্নাম ছিল। মদ-গাঁজা খেতেন, গান-বাজনা করতেন। পৈতৃক জমিদারির আয় ছিল, তাতেই চলে যেত। আজকের এই ব্যাধিও সে-সময়ের অপচয়ের ফল বলেই অনেকে সন্দেহ করেন।
এক বড়লোকের মেয়েকে মনে ধরেছিল তার। তাকে সত্যিই ভালোবাসতেন। মেয়েটি ঘৃণা করতেন তাকে, কিন্তু তার গান পছন্দ করতেন। সেই বাসনায় মোহগ্রস্ত। মেয়ের দাদার বন্ধু ছিলেন গাঙ্গুলি কাকা। তারা কায়স্থ। তবু সেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ক্ষেপে উঠেছিলেন তিনি। ফলে মর্মান্তিক বিচ্ছেদ, গাঙ্গুলি কাকার বাড়িতেও এ নিয়ে গঞ্জনা-লাঞ্ছনা। সব বাধা উপেক্ষা করে ওই মেয়েকে নিয়ে পালানোর ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটি টের পাওয়ার ফলে ষড়যন্ত্র বানচাল। আর তা প্রকাশ হবার ফলে গাঙ্গুলি কাকার অদৃষ্টে দ্বিগুণ লাঞ্ছনা।
মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেল। বড়লোকের বাড়িতেই বিয়ে হল। অনেক দূরে, আসামের বাইরে।
আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে গাঙ্গুলি কাকা এই বাড়িতে এসে আস্তানা নিলেন। আর আত্মঘাতী আনন্দে, অপচয়ের পাঁকে ডুবতে লাগলেন।
বছর দেড়েক বাদে সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন, তার শয্যার একধারে দেড়মাসের একটা মেয়ে ঘুমুচ্ছে। রাতের নেশার ঘোর কাটেনি কিনা বুঝলেন না। চোখ কচলে আবার দেখলেন। সত্যিই মেয়ে একটা!
রাতে ঘরের দরজার কপাট খোলা রেখেই শোন তিনি। কোন্ বাড়ির মেয়ে, কে কখন এসে রেখে গেল! মেয়ের হাতে বাঁধা একটা ভাজকরা কাগজ চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি সুতোটা ছিঁড়ে নিয়ে খুললেন সেটা। ছোট্ট চিরকুট!–দয়া করে রেখো ওকে। নিরুপায় হয়েই তোমার আশ্রয়ে রেখে গেলাম। কেউ জানবে না।–মণিমালা।
সেই মেয়ের নাম মণিমালা।
গাঙ্গুলি কাকা হতভম্ব। অনেক ভেবে একসময় মণিমালার বাপের বাড়ি গেলেন। জিজ্ঞাসাবাদ না করেও বুঝলেন, সেখানে কেউ তার খবর রাখে না। ভাবতে ভাবতে গাঙ্গুলি কাকা ফিরে এলেন।
এর ঠিক তিন দিন বাদে কাগজে মণিমালার আত্মহত্যার খবর বেরুলো। তার নাকি মাথাখারাপ হয়েছিল। আত্মহত্যা করার আগে নিজের মেয়েকেও হত্যা করে। গেলেন লিখেছেন। কিন্তু সেই শিশুর দেহের কোনো সন্ধান মেলেনি।
কেন এরকম একটা ব্যাপার ঘটল সেই রহস্য আজও অগোচর।
ঘরে একটা শিশু পুষছেন, ছমাসের মধ্যেও গাঙ্গুলি কাকা সেটা বাইরে কাউকে জানতে দিলেন না। পরে সকলে জানল, গাঙ্গুলি কাকারই মেয়ে, কোথায় কি কাণ্ড করে বসেছিলেন, এ তারই ফল।
সেই শিশুকন্যাই এই মনোরমা।
গাঙ্গুলি কাকার বাড়িতে প্রেমানন্দ ঘোষের যাতায়াত বেড়েছে। পরে সেটা দুবেলায় দাঁড়িয়েছে। মনোরমাকে যত বেশি দেখেছেন তিনি তত বেশি নিজেকে হারিয়েছেন। হারাবার নেশাতেই আবার ছুটে এসেছেন। কিন্তু ভিতরে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাঁর। রক্ষণশীল পরিবার তাদের, বাপ সাধারণ উকীল, চেহারার জোরে ছেলে দেখেশুনে শাঁসালো মুরুব্বি ধরবে–ঘরে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা আসবে–সেই আশায় আছেন। অতএব দুর্ভাবনার কারণ বইকি তার। কিন্তু দ্বিজেন গাঙ্গুলির বাড়ি এলে তার সব ভাবনা-চিন্তা নিঃশেষে তলিয়ে যায়। দুনিয়ার বিপ্ন ঠেলে সরিয়ে ওই মেয়েকে ঘরে নিয়ে তুলতে চান তিনি।
ফেরার দিন দশেক আগে ঘোষণা করলেন, মনোরমাকে বিয়ে করবেন। শুধু তাই নয়, একেবারে বউ নিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। এ প্রস্তাবে আপত্তি একমাত্র রণদা। চ্যাটার্জী তুলেছিলেন, সেটা ঠিক হবে না, আগে বাবা-মাকে জানানো দরকার।