যেমন এসেছিল সুবল মিশ্র তেমনি নিঃশব্দেই ফিরে গেছে।
.
মাতৃকুটীতে আমার আনাগোনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল।
মায়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ব্যস্ত থাকলে ব্যারিস্টার মহানন্দ ঘোষের সঙ্গে গল্প করি। তার স্ত্রী ঊর্মিলার সঙ্গে কথাবার্তা গল্পগুজব আরো বেশি হয়। মা তাও এক এক সময় লক্ষ্য করেন আর মুখ টিপে হাসেন। কখনো বা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার গল্প কতদূর এগোলো?
গল্প এগোচ্ছে কিনা সেটা আমি জানি আর ঊর্মিলা জানেন। একজনের জানার আগ্রহের সঙ্গে আর একজনের জানানোর আগ্রহ মিলেছে। কিন্তু সোজাসুজি আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করি না, তিনিও সরাসরি কিছু বলেন না। এই জানা আর জানানোর মধ্যে কখনো স্পষ্ট কখনো অস্পষ্ট অথচ অনায়াসে একটা লুকোচুরি খেলা চলেছে। যেন। কথাপ্রসঙ্গে কথা ওঠে, যেটুকু বললে চলে, তিনি হয়ত তার থেকে একটু বেশি বলেন। আর যেটুকু শুনলে কৌতূহল মেটে, আমি তার থেকে একটু বেশি শুনতে চাই।
মাকে নিয়ে সত্যিই কিছু লেখা হবে কিনা ঊর্মিলা নিঃসংশয় নন। কিন্তু আগ্রহ যে তাঁরই সব থেকে বেশি সেটা সহজেই বোঝা যায়। কথার মাঝে থমকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করেন, সত্যিই আপনি লিখবেন নাকি কিছু?
মৃদু হেসে ব্যারিস্টার সাহেব আমাকে সতর্ক করেছেন, লিখতে গিয়ে আপনি মশায় না ফ্যাসাদে পড়ে যান, মাকে যিনি চেনাচ্ছেন আপনাকে, তিনি নিজেই কিন্তু অন্ধ
ঊর্মিলা হাসিমুখেই রাগ করেছেন, বেশ, তুমিই তাহলে ভদ্রলোককে সাহায্য করো না একটু, মা তো পারমিশন দিয়েইছেন!
হাসির মধ্যে মহানন্দ ঘোষকে অন্যমনস্ক হতে দেখেছি। একটু চুপ করে থেকে বলেছেন, মানুষের ভিতরটা বড় বিচিত্র ব্যাপার, কখন কোন ছোঁয়া লেগে কি কাণ্ড যে ঘটে যায়!…আমার এই মাকে দেখা, আকাশ দেখার মতই সহজ, কিন্তু চেনা বড় কঠিন। কথা কটা বলেই আত্মস্থ হয়ে হেসেছেন আবার, বলেছেন, জোড়া অন্ধের। হাতে পড়ার থেকে এক অন্ধের হাতে পড়াই নিরাপদ আপনার পক্ষে।
তবু কথাপ্রসঙ্গে হোক বা জ্ঞাতসারেই হোক, সাহায্য তিনিও করেছেন আমাকে। যেটুকু আমি পেয়েছি তাই দুর্লভ মনে হয়েছে।
ছুটি ফুরোতে ব্যারিস্টার সাহেব সপরিবারে কলকাতা রওনা হয়ে গেলেন। আমার আরো আগেই ফেরার কথা ছিল। শিগগীরই ফিরব শুনে তাঁরাও সাগ্রহে আমাকে তাদের সঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমার কবে যাবার সময় হবে যে শুধু আমিই জানতাম।
তারা চলে যাবার ঠিক চার দিন বাদে সন্ধ্যার পর আমি মায়ের কাছে এলাম। একা। মা তখন পুজোর ঘরে যাবেন বলে পা বাড়িয়েছেন। আমাকে দেখে দাঁড়ালেন।–সুবল বলছিল, তুমি দুই-একদিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছ?
–হ্যাঁ, কাল যাব ভাবছি।
মা সাদা মনে বললেন, তাহলে তো নন্দদের সঙ্গে গেলেই পারতে, এত পথ একা-একা যেতে কষ্ট হবে।
-আপনার জন্যেই থেকে গেছি, আপনি বলেছিলেন লেখা যাচাই করিয়ে নিতে।
মায়ের মুখে প্রথমে বিস্ময়, পরে কৌতুক-মাধুর্যের নীরব বিন্যাস দেখলাম আমি। তার চোখে হাসি, মুখে হাসির আভাস।
-সত্যি লিখেছ নাকি?
আমি মাথা নাড়লাম- সত্যি।
–আচ্ছা, এসো।
আমাকে সঙ্গে করে সোজা পুজোর ঘরেই ঢুকলেন তিনি। তার আসন পাতাই ছিল, অদূরে আর একখানা আসন পেতে দিলেন।–বসো, এখানে বসেই শুনি কি লিখেছ!
আমি যা লিখেছি সেটা আর যাই হোক চমকপ্রদ গল্প কিছু নয়। হৃদয়ের চিত্র বলা যেতে পারে। তবে বিচিত্র বটে।
আমি পড়ছি। বাহুল্যবর্জিত খুব সংক্ষেপে আঁকা চিত্র। অদূরের আসনে বসে মা নিষ্পলক আমার মুখের দিকে চেয়ে শুনছেন।
.
ঘটনার প্রথম পটভূমি এখানেই। এই মাতৃকুটীরের জায়গায় যে ভাঙা বাড়ি ছিল, সেখানে। বাড়িতে থাকতেন বৃদ্ধ দ্বিজেন গাঙ্গুলি আর তার মেয়ে মনোরমা। বয়েস হিসেব করলে দ্বিজেন গাঙ্গুলিকে প্রৌঢ় বলা যেত। অবশাঙ্গ রোগী তিনি, অকালে বার্ধক্য এসেছে।
কলেজের খাতায় মনোরমার নাম ছিল। কিন্তু যেতে কমই পারতেন। প্রথম বাধা বাপের ব্যাধি, দ্বিতীয় বাধা মেয়ের রূপ, তৃতীয় বাধা তার মেজাজ। রূপের কারণে স্তাবকদের অত্যাচার আর মেজাজের কারণে প্রায়ই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব। অসচ্ছল ঘরের রূপের প্রতি মানুষের লোভ বেশি অশালীন হয়ে উঠতে চায়। আর সেই রূপের ওপর মেজাজের ছটা দেখলে তাদের আচরণ আরো বেশি জ্বর হয়। মনোরমা কলেজে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়।
(এইটুকু পড়েই আমি মায়ের দিকে তাকিয়েছিলাম। তাঁর মুখ নির্লিপ্ত, ভাবলেশশূন্য।)।
ওই ভাঙা বাড়িতে নতুন একজনের পদার্পণ ঘটল একদিন। কলকাতার প্রেমানন্দ ঘোষ। সবে ল ফাইন্যাল দিয়েছেন। অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সহপাঠী রণদা চ্যাটার্জীর সঙ্গে আসামে বেড়াতে এসেছেন। রণদা চ্যাটার্জীর বাবার তখন আসামে কর্মস্থল।
বন্ধুকে সঙ্গে করে রণদা চ্যাটার্জী গাঙ্গুলি কাকাকে দেখতে এসেছেন। পাড়ার সম্পর্কে কাকা। কাকার অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গরা এখনো তাদের পাশের বাড়িতে থাকেন। এক গাঙ্গুলি কাকাই শুধু সকলের সংস্রব ছেড়ে ওই বাড়িতে বাস করছেন ওই মেয়ের জন্মেব আগে থেকে। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে তার পোষায়নি। কিন্তু বাড়ি ছাড়লেও রণদা চ্যাটার্জীর বাবার সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে হৃদতা এবং যাতায়াত।
রণদা চ্যাটার্জী গাঙ্গুলি কাকাকে দেখলেন এবং তাঁর শয্যার পাশে বসে সুখদুঃখের কথা কইতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ঘোষ বাড়ির আর একজনকে দেখলেন বার কয়েক, এবং দেখে সারাক্ষণ বোবা হয়ে বসে থাকলেন। সকলের অগোচরে দুচোখ তার এই ভাঙা বাড়ির আনাচে-কানাচে উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগল। যাঁকে এই ঘরের মধ্যে দুই একবার দেখেছেন তাকে আবার দেখার জন্য তার নির্বাক দৃষ্টি থেকে থেকে উসখুস করে উঠতে লাগল।